ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুই সংস্থার ঠেলাঠেলি-শাহজালালে ধুঁকে ধুঁকে মরছে ৩৬ ছাগল

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

দুই সংস্থার ঠেলাঠেলি-শাহজালালে ধুঁকে ধুঁকে মরছে ৩৬ ছাগল

আজাদ সুলায়মান ॥ উপযুক্ত পরিবেশ ও খাদ্যের অভাবে একের পর এক মরছে উন্নত প্রজাতির ছাগল। বুধবারও মরেছে একটি বাচ্চা। আরও কয়েকটি মরার পথে। তবুও খালাস করতে দেয়া হচ্ছে না। দুবাই থেকে কার্গোযোগে আমদানি করা এসব প্রাণী আইনী জটিলতার দোহাই দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে আটকে রাখা হয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কাস্টমস ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের ঠেলাঠেলিতে বিপাকে পড়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাভার এ্যাগ্রো। এরই মধ্যে চারটি ছাগল মারা গেলেও টনক নড়েনি কোন মহলেরই। এ ঘটনায় ঢাকা কাস্টমস হাউসের ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বোবা এসব প্রাণীর আর্তচিৎকারে আশপাশের সবার বিবেকে নাড়া দিলেও এতটুকু মানবিক আচরণ দেখাচ্ছে না ঢাকা কাস্টমস হাউস ও প্রাণিসম্পদের হর্তাকর্তারা। তাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কজন সিএন্ডএফ কর্মীর মন্তব্যÑ বোবা এসব প্রাণী শুধু সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় খাবার ও পরিবেশ না পাওয়ায় সারাক্ষণ চিৎকার করছে। কাস্টমস ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের যারা এই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের ভূমিকা পশুর চেয়েও অধম? ঢাকা কাস্টমসের কমিশনার মান্নান শিকদার বলেছেন,বন অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এগুলো ছাড়া যাচ্ছে না। কোয়ারেন্টাইন বিভাগের অনুমতি না থাকায় এগুলো খালাসযোগ্য নয়। অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ক্ষিরেশ ভৌমিক বলেন, আমরা এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব, কোন রোগবালাই আছে কিনা। যদি না থাকে ছেড়ে দেয়া হবে। জানা গেছে, সাভার এ্যাগ্রো নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩৬ উন্নত প্রজাতির ছাগল ও ভেড়া কার্গোয় আমদানি করে গত ৫ অক্টোবর। একান্তই শখের বশে নিজের খামারের জন্য এগুলো সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ঢাকায় আনেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী দুবাইপ্রবাসী বাংলাদেশী নওয়াজেশ মাহমুদ সুমন। পরদিন তিনি ঢাকা কাস্টমস হাউসে গিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন। তখন তাকে বলা হয়- এগুলোর জন্য প্রাণিসম্পদ বা কোয়ারেন্টাইন বিভাগের অনুমতি বা ছাড়পত্র লাগবে। তিনি তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করেন শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো শাখায় কর্মরত কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তা ফারুকের সঙ্গে। তিনি পরামর্শ দেন, অনুমতি সহজে মেলে না। যেতে হবে হেড অফিসে মহাপরিচালক ক্ষিরেশ ভৌমিকের কাছে। সুমন সেখানে ছুটে যান। এবার তাকে বলা হয়, আবেদন করতে। আবেদনের পর দুই সপ্তাহ পার। আজও মেলেনি ছাড়পত্র। তিনি বার বার ঢাকা কাস্টমস আর প্রাণিসম্পদ বিভাগে দৌড়ঝাঁপ ও ধর্ণা দিয়ে চলছেন। কেউ ছাগলগুলোর নিদারুণ যন্ত্রণা লাঘবে সাড়া দেয়নি। দুবাই থেকে ৫ ঘণ্টা আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা অবতরণের পর থেকেই টানা তিনদিন ছাগলগুলোকে খাবার ও পানি খেতে দেয়া হয়নি। কার্গো হাউসের বাইরে একটি শেডের নিচে চারটি খাঁচায় আবদ্ধ ছাগল ও ভেড়াগুলোর মধ্যে তিনটি গর্ভবতী। তারা খাবার না পেয়ে চিৎকার ও ছটফট করতে থাকে। সুমন প্রতিদিন ঘাস ও খাবার নিয়ে কার্গো হাউসে ধর্ণা দেন। কিন্তু তাকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। কর্তব্যরত কাস্টমস কর্তা কঠোর নিষেধাজ্ঞা, কাস্টমসের অনুমতি ছাড়া খাবার দেয়া যাবে না। তিনি আবার ছোটেন ঢাকা কাস্টমস হাউসে, কিন্তু বৃথাই ছোটাছুটি। তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে চতুর্থ দিন একটি ছাগল মারা যায়। তখন কাস্টমসের টনক নড়লে ছাগলের খাঁচায় খাবার পৌঁছানোর মৌখিক অনুমতি দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বার বার ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মান্নান শিকদার ও ফার্মগেটের প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ক্ষিরেশ ভৌমিকের দফতরে আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট আর টি ধর্ণা দিলেও কোন ফায়দা হয়নি। দু’সপ্তাহ ধরেই দুই সংস্থার কাছে দেনদরবার করছেন আমদানিকারক। কাস্টমস বলছে, প্রাণিসম্পদের অনুমতি ছাড়া এগুলো খালাস করা যাবে না। প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, ছাড়া না ছাড়া কাস্টমসের এখতিয়ার। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে-এই দুই সংস্থার ঠেলাঠেলিতে এরই মধ্যে চারটি ছাগল মারা গেছে। আরও মরার পথে। এ দায় নেবে কে ? প্রাণিসম্পদের অনুমতি কি পেতে কি দুই সপ্তাহ সময় লাগার কথা ? জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার মান্নান শিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সুস্পষ্ট বলতে পারি, আমাদের কোন দায় নেই। প্রাণিসম্পদ বিভাগের অনাপত্তি বা ছাড়পত্র আনা হলে আমরা খালাস করে দেব। এ প্রসঙ্গে তিনি বন অধিদফতরের গত ৮ এপ্রিলের একটি চিঠির দোহাই দিয়ে বলেন, এগুলো আমদানি নিষিদ্ধ। এজন্যই বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া খালাস করা যাচ্ছে না। তার এ হেন ব্যাখ্যায় কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। বন অধিদফতরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে লেখা রয়েছে, ভুয়া এনওসির মাধ্যমে কেউ খাঁচায় পোষ্য পশুপাখি আমদানি করতে চাইলে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পোষ্য পাখি বিধিমালা ’১৬ অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত ভুয়া এনওসির মাধ্যমে আমদানি করা পাখি ছাড়া যাবে না। এ চিঠির আলোকে আমদানিকারকের দাবি, এখানে কোন ভুয়া এনওসি দাখিল করা হয়নি। আবার এগুলো খাঁচায় পোষা পাখিও নয়। কাজেই কাস্টমস এই দোহাই দিয়ে ছাগল ও ভেড়া আমদানিতে বাধা দিতে পারে না। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের ক্ষিরেশ ভৌমিক বলেন, আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি ছাগলগুলোর শরীরে কোন রোগবালাই আছে কিনা। আজকেই (মঙ্গলবার) নমুনা করেছি। এগুলো টেস্ট করে যদি দেখি দেয়ার মতো তাহলে দিয়ে দেব। এই পরীক্ষা করতে দু’সপ্তাহ দেরি করার দরুন চারটি ছাগল মারা গেলÑএ দায় কার, প্রশ্ন করা হলে ক্ষিরেশ ভৌমিক বলেন, দায় আমদানিকারকের।
×