ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণ চট্টগ্রামে দুই বড় দল একক ও জোটগতভাবে সমান

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

দক্ষিণ চট্টগ্রামে দুই বড় দল একক ও জোটগতভাবে সমান

মোয়াজ্জেমুল হক/ হাসান নাসির ॥ ভোটযুদ্ধে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ফলাফলের আগাম ধারণা বরাবরই দুষ্কর। এখানে অতীতে বিএনপির অবস্থান ছিল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। একটি আসনকে ভাবা হয় জামায়াতে ইসলামীর দুর্গ। ওই আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ছিল। ২০১৪ সালে এ আসনটি বর্তমান সরকারী দলের করায়ত্ত হয়। তবে বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ক্রমেই শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগের অবস্থান। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৫ আসনের মধ্যে দু’টিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান সুদৃঢ়। কিন্তু অপর তিনটি আসনে দলগত বা জোটগত যেভাবেই হোক, শক্তি সমানে সমান। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার অধীনে সংসদীয় আসন ৫টি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় সবকটি আসনেই আওয়ামী লীগ। এর আগে অর্থাৎ নবম সংসদ নির্বাচনে দুটিতে বিএনপি, একটিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে এলডিপি এবং একটিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপি থেকে কর্নেল (অব) অলি আহমেদ, বীর বিক্রম বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই মূলত দক্ষিণ চট্টগ্রামে দলটির অবস্থান দুর্বল হতে শুরু করে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শক্তি প্রায় সমান। তারপরও নানা সমীকরণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দল অংশগ্রহণ করলে ফলাফল হতে পারে মিশ্র। একটি আসনে মহাজোট প্রার্থী হিসেবে ভাগ বসাতে পারে জাতীয় পার্টি। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের এ আসনগুলোতে কোন্ দল থেকে কে প্রার্থী হতে পারেন তা নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা। আওয়ামী লীগ চায় তাদের সকল আসন ধরে রাখতে। অপরদিকে বিএনপি চাইবে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি আসনে প্রার্থী হতে নেতারা এখন থেকেই নেমে পড়েছেন। চলছে গণসংযোগের পাশাপাশি কেন্দ্রের মন জয় করার চেষ্টা। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ॥ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বিপ্লবীদের কর্মকা-ের জন্য বিশেষভাবে আলোচিত। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধেও এ এলাকায় হয়েছে বেশকিছু দুঃসাহসিক অপারেশন। এলাকাটি প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত। তবে স্বাধীনতার পর থেকে দলীয় কোন্দল এবং প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগ ভাল ফল করতে পারছিল না। পটিয়া আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের সামসুল হক চৌধুরী। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি এমপি হয়েছিলেন। এবারও আওয়ামী লীগ থেকে তার দাবি সবচেয়ে জোরালো। কেন্দ্রের গুডবুকে রয়েছেন বলেও চাউর আছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের আরও যারা মনোনয়ন চাইতে পারেন তারা হলেন বিজিএমইএর সহ সভাপতি মোঃ নাসির উদ্দিন, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য চেমন আরা তৈয়ব এবং পটিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ। বিএনপি থেকে এবারও মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সংসদ সদস্য গাজী শাহজাহান জুয়েল। এছাড়া অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহ সভাপতি এনামুল হক এনামও অনেক আগে থেকেই এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন। শাহজাহান জুয়েল নানা কারণে দলের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এনামুল হক এনাম জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। পটিয়া আসন থেকে বিএনপি-আওয়ামী লীগের বাইরে যিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম। বাম গণতান্ত্রিক জোট যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তার প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া অন্য কোন দলের তৎপরতা তেমন লক্ষণীয় নয়। চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) ॥ এ আসনটিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান সব সময়ই ভাল ছিল। কিন্তু প্রয়াত দুই হেভিওয়েট নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবং আতাউর রহমান কায়সারের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ থাকায় কাক্সিক্ষত সুফল অতীতে ঘরে তুলতে পারেনি দলটি। আখতারুজ্জামান চৌধুরীর মৃত্যুর পর সেখানে নির্বাচন করে এমপি হন পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, যিনি বর্তমান সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী। প্রথম দিকে পূর্ববর্তী কোন্দলের রেশ থাকলেও এখন দলে তেমন কোন্দল নেই। আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদই প্রার্থী হবেন তা এক প্রকার নিশ্চিত। বিষয়টি ধারণা করতে পেরে আগ্রহী আর কোন প্রার্থীর দৌড়ঝাঁপ নেই। আনোয়ারা আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক এমপি সরোয়ার জামাল নিজাম। তিনি এর আগে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ফলে তার দাবিও জোরালো। তবে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক আরও নেতা রয়েছেন। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতা এ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরীসহ কয়েকজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) ॥ জাতীয় সংসদের এ আসনটি কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীর বিক্রমের আসন হিসেবে পরিচিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি বার বার বিজয়ী হয়েছেন এ আসন থেকে। হয়েছিলেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও। এ আসনটিকে বিএনপির ঘাঁটি মনে করা হতো। তবে তিনি বিএনপি ছেড়ে এলডিপি (লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি) গড়ার পর বিএনপির অবস্থান সেখানে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এলডিপি থেকেই এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন অলি। এবারও তিনি নির্বাচন করবেন। তবে কোন জোট থেকে বা কিভাবে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ২০ দলীয় জোটে থাকলে তিনি হবেন ছাতা প্রতীকে ওই জোটের প্রার্থী। আর যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয় তাহলে তিনি পাবেন ওই দলের সমর্থন। চন্দনাইশ আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের নজরুল ইসলাম চৌধুরী। এবারও তিনি মনোনয়ন চাইবেন। তবে বিএনপিহীন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে গত পাঁচ বছরে তিনি এলাকায় সাংগঠনিক ভিত শক্ত করতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে আলোচনায় রয়েছেন এর আগে একাধিকবার আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচন করা ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন আহমেদ। তিনি বিজিসি ট্রাস্ট ইউনির্ভাসিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং এলাকায় শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক হিসেবে পরিচিত। এছাড়া দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান দলের একটি বড় অংশ। এলাকায় এই নেতার গণসংযোগও রয়েছে। বিএনপি থেকে এ আসনে মাঠ পর্যায়ের নেতা তেমন নেই। দলটির রাজনৈতিক তৎপরতাও অনেক কমে গেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুরের সহোদর ডাঃ মহসিন জিল্লুর চন্দনাইশ আসনে বিএনপির মনোনয়নে প্রার্থী হতে পারেন এমন আলোচনা এলাকায় রয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডাঃ শাহাদাত হোসেনের বাড়িও চন্দনাইশে। তবে এ নেতার আগ্রহ চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি আসনকে ঘিরে। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) ॥ এ আসনটিতে জামায়াতে ইসলামীর শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী। তবে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় এবার আর নিজের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে সাবেক সংসদ সদস্য আ ন ম শামসুল ইসলাম বা শাহজাহান চৌধুরী স্বতন্ত্র অথবা বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতায় ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে পারেন। তবে দু’জনই জড়িয়ে আছেন নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায়। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের ড. আবু রেজা নদভী। বিগত নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় খুব সহজেই তিনি সংসদ সদস্য হয়ে যান। তবে এই পাঁচ বছরে সাংগঠনিক কর্মকা-ে তাকে সক্রিয় দেখা যায়নি বলে অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। সে কারণে তারা দলের স্বার্থে প্রার্থীর পরিবর্তন চান। শেষ পর্যন্ত এখানে প্রার্থিতা বদল হতে পারে, এমন আলোচনাও রয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার মতো শক্তিশালী নেতা রয়েছেন দু’জন। তারা হলেন কেন্দ্রীয় কমিটির উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন এবং উপ দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। দু’জনই নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের পরিচালক ও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং এক সময়ের দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সুফিয়ানও মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ভোটে জেতার বিষয়, নাকি সাংগঠনিক বিষয় প্রাধান্য পাবে, তার ওপর নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এ আসনে বেশ দুর্বল। জনসমর্থনও অনেক কম। নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন এমন আলোচিত নেতাও তেমন নেই। ফলে আসনটিতে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে কোন না কোনভাবে সমঝোতা হবে, এমনই ধারণা এলাকাবাসীর। চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) ॥ বাঁশখালী আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের মোস্তাফিজুর রহমান। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সরকারী- বেসরকারী এমনকি সংবাদকর্মীকে মারধরসহ কিছু কর্মকা-ের জন্য তিনি বিতর্কিত হয়েছেন। প্রার্থী বদলের জন্য দলের একাংশের দাবি রয়েছে। তবে একবার সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ায় তিনিই নৌকা প্রতীকের জোরালো দাবিদার। এর বাইরে আর যারা নির্বাচন করতে চান তার মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির চৌধুরী লিটন এবং শিল্পপতি ও একটি পত্রিকা সম্পাদক মজিবুর রহমান। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় এ আসনটি চলে যেতে পারে জাতীয় পার্টির দখলে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীর বাড়ি এই বাঁশখালীতে। তিনি এলাকায় গণসংযোগ এবং সামাজিক কর্মকা-ে সক্রিয়। কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ দুই দলের বেশ কাছাকাছি। জাতীয় পার্টির সঙ্গে যদি আসন সমঝোতা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এ আসনটি চাওয়া হতে পারে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এই আসন থেকে এমপি ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এ আসনে বিএনপি সাংগঠনিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল। তবে ভবিষ্যতের জন্য আসনটিকে টার্গেট করে রাজনৈতিক কর্মকা- চালিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আন্দোলনের নামে বেইলি ব্রিজ উপড়ানো, গাছ কাটা, জ্বালাওপোড়াওসহ কর্মকা-ে সক্রিয় ভূমিকা ছিল জামায়াতের। তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে এলে জাফরুল ইসলাম চৌধুরীই ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন তা এক প্রকার নিশ্চিত। সেখানে দলটির অন্য কোন নেতার তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়।
×