ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ভাঙ্গন শুরু

জামায়াতকে খুশী রাখতে বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

জামায়াতকে খুশী রাখতে বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট

শরীফুল ইসলাম ॥ মাঠের এবং ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত ছাড়া কার্যত অচল বিএনপি। জোটসঙ্গী জামায়াত ছাড়া বিএনপির কোন কর্মসূচীই সফল হয় না তা বিগত ১০ বছরে প্রমাণিত হয়েছে। আর এ জন্যই জামায়াতকে খুশি রাখতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে বিএনপি। তবে বিএনপির এ সিদ্ধান্তে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা হতাশ হয়েছেন। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ২০ দলীয় জোটের ভাঙ্গন। ইতোমধ্যেই দু’টি দল জোট ত্যাগ করেছে। এ দু’টি দলকে অনুসরণ করে আরও কয়েকটি দল বের হয়ে যেতে পারে। এদিকে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে মূল্যায়ন না করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নামসর্বস্ব দলগুলোকে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করার প্রতিবাদে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে ন্যাপ ও এনডিপি। মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে ন্যাপ সভাপতি জেবেল রহমান গানি ও এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মর্তুজা ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। গুলশানের একটি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, এভাবে বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে অন্যদের নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট করায় আমরা হতাশ হয়েছি। সূত্র মতে, বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জোট হলে জামায়াত ছাড়া ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলই মেনে নেয়ার পক্ষে ছিল। আর জামায়াতও শেষ পর্যন্ত না মেনে নিয়ে পারত না। তবে জামায়াত বেঁকে বসতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে বিএনপি বি চৌধুরীকে বাদ দিয়েই জোট করে। আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে ন্যাপ ও এনডিপি। তবে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এতে জোটের কোন সমস্যা হবে না। কারণ, এ দুটি দলের অন্য নেতারা তাদের সঙ্গে রয়েছেন। তাই এ দুই নামে জোটের শরিক দল থাকবে। সে ক্ষেত্রে এ দুই দলের নেতৃত্ব পরিবর্তন হবে। জানা যায়, বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী ও দলীয় বুদ্ধিজীবীরা চেয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক বি চৌধুরীর সমন্বয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করতে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতারা কিছুতেই জামায়াত ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না। তাই এমন একটি বড় জোট গঠন করতে জামায়াত প্রশ্নে প্রথমেই হোচট খায় বিএনপি। ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক বি চৌধুরী বিএনপিকে জামায়াত ছেড়ে আসার আহ্বান জানায়। কিন্তু তাদের এ আহ্বানে বিব্রত হয় বিএনপি। দীর্ঘদিনের জোট সঙ্গী জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না বিএনপি নেতারা। এক পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকা নিয়ে ড. কামাল হোসেন নমনীয় হলেও অধ্যাপক বি চৌধুরী সাফ জানিয়ে দেন বৃহত্তর ঐক্য করতে হলে জামায়াত ছাড়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডনপ্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত নেন দলের সিনিয়র নেতারা। তবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জামায়াত রেখে কিভাবে বৃহত্তর ঐক্য করা যায় সে চেষ্টা করতে বলেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল এ দলের এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা ড. কামাল হোসেনের। আর এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে নানা ধরনের টোপ দেয়া হয় ড. কামাল হোসেনকে। সম্প্রতি বিদেশ সফর করে দেশে আসার পর ড. কামাল হোসেন বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট করার বিষয়ে আর জামায়াতকে বাধা মনে করেননি। বিএনপির বিভিন্ন কৌশলের কাছে হেরে যান ড. কামাল হোসেন। এ পরিস্থিতিতে অধ্যাপক বি চৌধুরীকে পাশ কাটিয়ে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপি নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিএনপি ড. কামালকে অধ্যাপক বি চৌধুরীকে ছাড়া ঐক্য করতে রাজি করায়। আর কিভাবে অধ্যাপক বি চৌধুরীকে পাশ কাটানো যায় এ নিয়ে কৌশল গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ১৩ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠক ডাকা হয় এবং অধ্যাপক বি চৌধুরীকে ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু অধ্যাপক বি চৌধুরী ড. কামাল হোসেনের বাসায় গিয়ে দেখেন ওই বাসায় কেউ নেই। এ সময় ড. কামাল তার মতিঝিলের চেম্বারে বসে ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপিসহ অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। এ অবস্থায় অধ্যাপক বি চৌধুরী অপমানিত বোধ করে বারিধারায় নিজ বাসায় ফিরে যান। ওই দিনই বিএনপি, জাসদ (রব) ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন। পরে অধ্যাপক বি চৌধুরীও তার বারিধারার বাসায় বসে সংবাদ সম্মেলন করে এভাবে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের তীব্র সমালোচনা করেন। এ পরিস্থিতিতে অধ্যাপক বি চৌধুরীকে কিভাবে ঐক্যফ্রন্টের সমালোচনা থেকে বিরত রাখা যায় সে চেষ্টার অংশ হিসেবে ১৫ অক্টোবর বি চৌধুরীর বারিধারার বাসায় ছুটে যান বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি এ সুযোগে বি চৌধুরীকে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়ারও অনুরোধ করেন। কিন্তু বি চৌধুরী এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের কঠোর সমালোচনা করেন। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বিকল্পধারার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী জানিয়েছেন, এভাবে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়েই ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন, যা সত্যিই দুঃখজনক। এভাবে ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক ঐক্য মেনে নেয়া যায় না। তবে মাহ বি চৌধুরীর এমন কথার জবাবে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভুলত্রুটি সংশোধন করে এখনও ড. কামাল হোসেন ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন সম্ভব। আমরা এ বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদিকে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এতদিন বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট নিয়ে কোন কথা না বললেও বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করার পর এ জোটে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ জোটের অধিকাংশ দলই জামায়াতের পক্ষে কাজ করে। বি চৌধুরী বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে কঠোর জামায়াত বিরোধী ছিলেন। তাই বি চৌধুরীকে বাদ দিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট করায় জামায়াত খুশি হওয়ায় জোটের অন্য সব দলই খুশি হয়। কারণ এভাবে জোট করায় এখন জামায়াতকে নিয়ে আর বৃহত্তর জোটে কোন প্রশ্ন উঠবে না। এ পরিস্থিতিতে ১৫ অক্টোবর ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানানো হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, মাঠের রাজনীতি ও ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে দলীয় হাইকমান্ড আপাতত জামায়াত না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, রাজপথের যে কোন কর্মসূচীতে জামায়াতের নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এবং কর্মসূচী শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়েন না। এ ছাড়া সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে জামায়াতের ভোট ব্যাংক রয়েছে। বাস্তবতার কারণেই এসব কিছু বিবেচনায় না রাখতে হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক বি চৌধুরী এক সময় জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করলেও এখন এত বিদ্রোহী হওয়ার বিষয়টি দলের নেতাকর্মীরা সন্দেহের চোখে দেখছেন। তাই অধ্যাপক বি চৌধুরীকে ছাড়াই বিএনপি ড. কামাল হোসেনসহ অন্যদের সঙ্গে জোট করেছে। এদিকে এখন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও মাঠের আন্দোলনে ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটগতভাবেও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করবে বিএনপি। তবে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচী সমন্বয় করে বিএনপি কর্মকা- চালিয়ে যাবে। কারণ, উভয় জোটের লক্ষ্যই হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ ছাড়া উভয় জোটই আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে চায় তারা। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক। তাই ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট যুগপৎ কর্মসূচী পালন করবে। এতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ, উভয় জোটের সঙ্গে আলোচনা করেই বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। শীঘ্রই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দেশব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন শুরু করবে। নির্বাচন কমিশনের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩০ অক্টোবরের পর যে কোন দিন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। আর তফসিল ঘোষণার পরই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট যুগপথ আন্দোলন কর্মসূচী শুরু করতে চায়। আর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ঘোষণা দিয়েছে তারা রাজপথেই ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচী মোকাবেলা করবে। এ পরিস্থিতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথ উত্তপ্ত হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল আশঙ্কা করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির দাবিতে আন্দোলন করবে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনকালে সেনা মোতায়েন ও ইভিএম যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ না করা। আর আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করারা পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করবে। সে ক্ষেত্রে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোরভাবে তা দমন করবে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সরকারী দলের পক্ষে থাকবে।
×