ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সতীশ চন্দ্র সরকার

অসুর বিনাশিনী

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

অসুর বিনাশিনী

শরত এলেই যাঁর পদধ্বনি শোনা যায়, যাঁর আবাহনে শরত তার সবটুকু মাধুর্য উজার করে প্রহর গোনে, তিনি আমাদের চিন্ময়ী মা দুর্গা। যাঁর মৃন্ময়ী রূপ আমাদের মানসপটে চির জাগরূক, এক মহাশক্তিরূপে। মৃন্ময়ীর মাঝেই আমরা চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করি, অনুভব করি এবং অন্তরে ধারণ করি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন- ‘একই বস্তু, নামভেদ মাত্র।’ যিনি ব্রহ্ম, তিনিই আত্মা, তিনিই ভগবান।’ হিন্দু শাস্ত্র বলে অসুরদের অত্যাচারে ধরণী যখন অতিষ্ঠ, দেবতারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরÑ এই ত্রিশক্তির সম্মিলিত তেজরাশি থেকে এক অপরূপ অগ্নিকন্যার আবির্ভাব হয়। তিনিই দেবী দুর্গা, যাঁর আক্ষরিক অর্থ হলোÑ দ-দৈত্যনাশক, উ-বিঘœনাশক, রেফ-রোগনাশক, গ-পাপঘœ, আ-ভয় ও শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। এজন্য তাঁকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। সকল দুঃখে তিনি সকলের মঙ্গল সাধন করেন। এজন্য শ্রীশ্রী চ-িতে (১১/১০)আছে ‘সর্ব মঙ্গল মঙ্গলে শিবে সর্বার্থ সাধিকে/শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণি নমোহস্ততে।’ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কড়লডেঙ্গা পর্বতশীর্ষে অবস্থিত চ-িতীর্থ মেধস মুনির আশ্রমে সর্বপ্রথম মা দুর্গা মৃন্ময়ী রূপে পূজিত হন। আর সে পূজা করেন রাজ্যহারা রাজা সুরথ ও স্বজন-পরিত্যক্ত বণিক সমাধি বৈশ্য। মেধস মুনি তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে মা দশভুজার পূজা করতে বলেছিলেন। আবার রামায়ণ থেকে জানা যায়, ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র সীতাদেবীকে উদ্ধারের জন্য শরতকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, একে অকাল-বোধন বলে। এভাবেই মর্তে মায়ের মৃন্ময়ীরূপে পূজার সূত্রপাত, যা আজও স্বাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। দুর্গাপূজা বাঙালীর সর্বজনীন মহোৎসব। দুর্গাম-পে বিরাজিত মায়ের কাঠামোর দিকে ভালভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, ঐক্যের সুতায় বাঁধা এ মহোৎসব। সমাজের উঁচু-নিচু সর্বস্তরের শ্রেণীপেশায় নিয়োজিত সবাই এ পূজার অংশীদার। মা দুর্গাতে নিহিত রয়েছে ত্রিশক্তির মিলিত তেজ, দুপাশে রয়েছে জ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, ঐশ্বর্যপ্রদায়িনী দেবী লক্ষ্মী, বলরূপী কার্তিক, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ এবং উর্ধে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্ত বিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। অর্থাৎ একইসঙ্গে অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, বল, সিদ্ধি ও ত্যাগের। শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতায় ৪-১৩ অধ্যায়ে শ্রী ভগবান বলেছেন ‘চতুর্বর্ন্যাং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশ। অর্থাৎ মানুষের গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রÑএই চার শ্রেণীতে বিভাজন করেছি।’ বর্তমানে যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়, তা কাম্য নয়। বরং এই চার শক্তি একত্রে থাকলে হিন্দু সমাজের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে। আবার যদি মায়ের সঙ্গে সঙ্গে পূজিত বাহনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে, সেখানেও গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। মা আদ্যাশক্তি এবং মহাশক্তির মূর্ত প্রতীক। তাই তাঁর বাহন পশুরাজ সিংহ। কার্তিকের বাহন সুশ্রী ময়ূর, এটি কামরহিত। পেঁচা দিবান্ধ, যারা ঈশ্বরকে ভুলে অন্ধকারে চলে, তাদের সে পথ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয় লক্ষ্মীর বাহন কুশ্রী পেঁচা। গণেশের হাতির মাথা বৃহতের প্রতীক, আর বাহন ইঁদুর ক্ষুদ্রত্বের প্রতীক। এভাবে বৃহতের সঙ্গে ক্ষুদ্রত্বের সমাবেশ দেখানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে সমাজে উঁচু নিচু, ধনী-দরিদ্র, কেউ ফেলনা নয়, সবারই প্রয়োজন রয়েছে। সরস্বতীর বাহন হাঁস, যে জলে মিশ্রিত দুধ থেকে জল ফেলে শুধু দুধটুকু গ্রহণ করে। অর্থাৎ অসার পরিহার করে সার বা ভাল কিছু গ্রহণ করার শিক্ষা এখানে নিহিত রয়েছে। এ পূজায় যে দ্রব্যসামগ্রী ব্যবহৃত হয়, তাতেও সর্বজনীনতার ছাপ সুস্পষ্ট। যেমন—-পঞ্চ পল্লব, পঞ্চ শস্য, পঞ্চ গব্য, ফুল, ফল, দূর্বা, তুলসী, সপ্তঘাটের জল, শিশির কণা, মন্দিরের চত্বরের মাটি যেমন লাগে, বারবণিতার আবাসের মাটিও এখানে যুক্ত হয়েছে। এ শিক্ষাই দেয়ার জন্য যে সমাজে যারা পতিত, অবহেলিত, মা তাদেরও দূরে সরিয়ে দেন না। তাদের জন্যও মায়ের ¯েœহধারা বর্ষিত হয়। এবার আসি নবপত্রিকা প্রসঙ্গে, মায়ের পাশে সাদা কাপড়ে সাজানো থাকে এটি। এতে রাখা হয়েছে কৃষির উপকরণ। ৯টি ওষধি বৃক্ষের অংশের সমন্বয় ঘটেছে সেখানে। যেমনÑ কলা, কালো কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু, ধান ইত্যাদি। এভাবে প্রকৃতিকে ভালবাসতে ও রক্ষা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যেগুলো লালন পালন করলে মানুষের জীবন সুস্থ ও সুন্দর হয়ে উঠবে। আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত মা দুর্গার সময়কাল। ষষ্ঠীতে হয় আবাহন ও বোধন, সপ্তমীর অন্যতম আকর্ষণ নবপত্রিকা স্থাপন। অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে হয় বিশেষ পূজা, যাকে সন্ধিপূজা বলে। এ শুভক্ষণেই দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা মহিষাসুর বধ করেছিলেন ত্রিশূল বিদ্ধ করে। নবমীতে হয় হোমযজ্ঞ। তারপর আসে সেই বেদনাঘন মুহূর্ত দশমী তিথি। অসুর বিনাশ করে, প্রকৃতিকে আনন্দে মাতিয়ে, ভক্ত-হৃদয়কে উদ্বেলিত করে মা সেদিন কৈলাসে যাবার জন্য পা বাড়ান। মায়েরা তেল, সিঁদুর আর চোখের জলে মাকে রাঙিয়ে দেন। একে অন্যকে প্রেমালিঙ্গনে আপ্লুত করেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত জীবের দুর্গতি দেখে মা বিচলিত হয়ে মর্তে নেমে আসেন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি ও তপস্যায় আদ্যাশক্তি মহামায়া হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য মহাশক্তি শুভশক্তির সেই মহাবিচ্ছুরণে চতুর্দিক আলোকময় হয়ে ওঠে, অন্ধকার বিদূরিত হয়। হয় অশুভ শক্তির বিনাশ। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান একই বৃত্তে মেলার ও মেলানোর এই প্রয়াসই হচ্ছে দুর্গোৎসব। ধর্ম যার যার, উৎসব সর্ব জাতি, ধর্ম বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার। দুর্গাপূজার মূল সত্য হলোÑ মা ধরায় আসেন সকল পাপ, সংকীর্ণতা, মলিনতা, ভেদাভেদ দূর করে সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসতে। মমতাময়ী মা যে আলো জ্বালিয়ে গেলেন ভক্ত হৃদয়ে, তা যেন অম্লান থাকে। মাগো এই আশীর্বাদ কর আমাদের। সমাজ থেকে যেন অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অশুভ ছায়া চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। সত্য ও সুন্দরের পতাকাতলে যেন সমগ্র বাঙালী জাতি শান্তিতে বসবাস করতে পারে। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বাউফল সরকারী কলেজ
×