ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অবিচলানন্দ

মৃন্ময়ী মূর্তিতে মা দুর্গা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৬ অক্টোবর ২০১৮

মৃন্ময়ী মূর্তিতে মা দুর্গা

শরতকালে বাংলায় মৃন্ময়ী মূর্তিতে শ্রীদুর্গার অর্চনা মহাসমারোহে উদ্যাপিত হয়। বস্তুত, এ পূজা বাঙালীর জাতীয় উৎসবে পরিগণিত। উপরন্তু এটি কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, আসমুদ্রহিমাচল, সর্বত্র অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ শুভ লক্ষণ শ্রীদুর্গাকে প্রসন্ন করার পক্ষে বিশেষ সহায়ক। ফলত মহামায়ার শারদীয়া পূজাকে আমরা যেন পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারি। শ্রীদুর্গার আরাধনা উপলক্ষে আমরা নিতান্ত বাহ্য অনুষ্ঠানেই মত্ত থাকব না, একই সঙ্গে শ্রীদুর্গার চিন্ময়ী সত্তায় যথাসাধ্য মনোনিবেশ করে তার শ্রীপাদপদ্মে আন্তরিক হতে যতœশীল হব। তিনি যেন প্রসন্ন হয়ে আমাদের মুক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। শক্তি বিশ্বজননী। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’Ñ সকল ভূতের মা রূপে অবস্থান। মা সারদাদেবীকে ভক্তসন্তান জিজ্ঞেস করল, ‘মা, আপনি কি এ সকল কীটপতঙ্গাদিরও মা?’ শান্ত স্বীকৃতি জানিয়ে মা সারদাদেবী বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, বাবা আমি ওদেরও মা।’ বৃক্ষলতা, পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ, দেব-মনুষ্য সকলেরই মা, বিশ্বজননী। তার পূজা দুর্গাপূজায়, বিশেষ নবপত্রিকায়। বাঙালী হিন্দুর বারো মাসে তেরো পার্বণ। এ পার্বণ মানে পূজা, উৎসব ইত্যাদি। এরই মাধ্যমে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা পূজা উৎসবাদিতে একে অন্যের অভাব নিবারণার্থে গরিব-দুঃখী, আর্ত-নিপীড়িতদের মাঝে খাদ্য-বস্ত্রাদি বিতরণ করে থাকেন। সর্বজনীনতার অঙ্গ হিসেবে কুমার তার জানা বিদ্যা দিয়ে সুন্দর সুন্দর মূর্তি গড়ে দেন। ঢাকি তার সুমধুর ঢাকের বাদ্যে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলকে মোহিত করে তোলেন। তাঁতি তার নিজ তাঁতে সুন্দর কাপড় বুনে দেন সকলের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানও হয়ে থাকে। শরত ঋতুতে বসুন্ধরা ফলে-ফুলে, শস্য-শ্যামলিমায় সুশোভিত হয়ে ওঠে। শিউলিসহ নানা ফুলের ঘ্রাণে প্রকৃতি নতুন সাজে সজ্জিত হয়। কারণ, বিশ্বজননী মা দুর্গা এসেছেন। দুর্গাপূজা যে এক সময় বাংলার গ্রামে গ্রামে হতো তার প্রমাণ, বেশিরভাগ সামর্থ্যবান হিন্দুর বাড়িতে চ-ীম-প ছিল। যে যুগে আমরা বাস করছি, দুর্ভাগ্যবশত তা স্বার্থপরতা, হিংসা, মিথ্যাচার ও সংঘর্ষে আন্দোলিত। সুস্থ’ চিন্তাশীল, হৃদয়বান মানুষের সংখ্যা যেন কমে আসছে। এমতাবস্থায় ঘন মেঘের আঁধার ভেদ করে শারদ-সূর্যের প্রকাশের মতোই আমাদের সংশয়দীর্ণ হৃদয়ে দিব্যজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ করছেন জগৎমাতা মহাশক্তি দেবীদুর্গা। তার সে আগমনীবার্তা ‘নিনাদিত হতেছে অনল অনিলে চির নভোনীলে...।’ আমরা রোমাঞ্চিত হই হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পুষ্পাঞ্জলি নিয়ে তার শ্রীচরণ দর্শন প্রত্যাশায়। তাকে কেন্দ্র করে আমাদের অন্তরে আজ অপরিমেয় আনন্দ-অনুভূতির উদ্ভাস। আমরা দেবীদুর্গার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাচ্ছিÑ তিনি আমাদের অন্তরের আসুরিক শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির উদ্বোধন করুন। আমরা যেন সাম্য, মৈত্রী, অহিংসা ও পরার্থপরতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তার সুসন্তানরূপে নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। নিছক উৎসব-আড়ম্বরে মত্ত না হয়ে আমরা যেন আমাদের অন্তরে এই মহাশক্তির উদ্বোধনে প্রতিনিয়ত ব্যাপৃত থাকতে পারি। সেই সঙ্গে মায়ের কাছে আকুল আর্তি, সাম্প্রতিক বন্যা-বিপর্যয়ে দেশের বিধ্বস্ত মানুষ যেন সুস্থ-সুন্দর জীবনে ফিরে আসতে পারে। তাদের দুঃখে আমরাও যেন মর্মে মর্মে সমবেদনা অনুভব করি। এ শুভলগ্নে জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনাÑ উৎসবের এই দিনগুলো যেন আমরা শান্তি ও আনন্দে, প্রীতি ও শ্রদ্ধায়, সহিষ্ণুতা ও সমন্বয়ে অতিবাহিত করতে পারি। আমরা যেন আমাদের দুর্বলতা, সঙ্কীর্ণতা ও স্বার্থবুদ্ধিকে অতিক্রম করতে পারি। মনুষ্যত্বকে যেন জাগ্রত রাখতে পারি। মা দুর্গা, আমাদের সকলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ করুন। আমাদের চারপাশের অসংখ্য দারিদ্র্যপীড়িত, অজ্ঞ, রোগগ্রস্ত, গৃহহীন, নিরন্ন মানবের সেবায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে জগত মাতার পূজা সম্পূর্ণ হবে। নর-নারীকে এক একটি প্রতিমা বলে ধারণা করতে পারলে মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ী মাতা অনুভূত হবে। জ্ঞানে, প্রেমে ও কর্মে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে একাত্মবোধেই দুর্গাপূজার সার্থকতা নিহিত। আদ্যাশক্তি শ্রীদুর্গার কৃপায় আমরা যেন ওই বোধে উত্তীর্ণ হতে পারি। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায়Ñ যিনি ব্রহ্ম তিনি শক্তি, শক্তি ব্রহ্ম থেকে অভিন্ন নয়। তার কৃপা পেতে হলে আদ্যাশক্তিরূপিণী তাকে প্রসন্ন করতে হবে। তিনি মহামায়া বা যোগমায়া। জগতকে মুগ্ধ করে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করছেন। তিনি অজ্ঞান করে রেখে দিয়েছেন। সেই মহামায়া দ্বার ছেড়ে দিলে তবে অন্দরে যাওয়া যায়। সে আদ্যাশক্তির ভেতর বিদ্যা ও অবিদ্যা দুই-ই আছে। অবিদ্যা মুগ্ধ করে; বিদ্যা যা থেকে ভক্তি, দয়া, জ্ঞান, প্রেম-ঈশ্বরের পথে লয়ে যায়। সে অবিদ্যাশক্তিকে প্রসন্ন করতে হবে। তাই শক্তির পূজা পদ্ধতি। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। পরম সত্যের এ যে ধারণা পরিপূর্ণভাবে রূপ নিতে বহু সময় লেগেছে, যদিও যত্রতত্র কোন কোন সাধক বা ঋষি সে সম্বন্ধে কিছু কিছু ধারণা বা আভাস-ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, উপাসনা একটি স্বতন্ত্র দর্শন। আমাদের অনুভূত বিবিধ ধারণার মধ্যে শক্তির স্থান সর্বপ্রথম। প্রতি পদক্ষেপে এটা অনুভূত হয়। অন্তরে অনুভূত শক্তি-আত্মা এবং বাইরে অনুভূত শক্তি-প্রকৃতি। এই দুইয়ের সংগ্রামই মানুষের জীবন। আমরা যা কিছু জানি বা অনুভব করি তা এ দুই শক্তির সংযুক্ত ফল। মানুষ দেখেছিল, ভাল এবং মন্দ উভয়ের ওপর সূর্যের আলো সমভাবে পড়ছে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এ এক নতুন ধারণা; এক সার্বভৌম শক্তি সবকিছুর পশ্চাতে। বেদান্ত অনুসারে পরম সত্য নির্গুণ এবং নাম ও রূপের অতীত। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতে সেই পরম সত্যই আবার নানা দেব-দেবীর রূপ ধারণ করে। আধ্যাত্ম্য ইতিহাসে এ রকম শত শত উদাহরণ পাওয়া যায়। পরম সত্যের আরাধনা অত্যন্ত প্রাচীন। দেবী-মাতৃকাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আরাধনা করা হয়। শরতকাল: শস্য-শ্যামলা কৃষিক্ষেত্র, স্বচ্ছ জলধারাবাহিত নদী, নির্মেঘ আকাশ, দিনে সূর্যালোকে সর্বদিক উদ্ভাসিত আবার রাতে শুভ্র চন্দ্রকিরণে স্নাত। ভক্তদের কাছে তিনি সত্য এবং সমস্ত ঘটনাই আধ্যাত্মিক সত্য, তিনি তাদের কাছে শুধু প্রতিমা নন, তিনি মূর্ত আদর্শ। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, উপাসনা অর্থাৎ তার কাছে প্রতিনিয়ত অকুণ্ঠ শরণাগতি আমাদের শান্তি দিতে পারে; তার জন্যই তাকে ভালবাসÑ ভয়ে নয় বা কিছু পাওয়ার আশায় নয়। তাকে ভালবাস, কারণ তুমি তার সন্তান। ভাল-মন্দে সর্বত্র তাকে সমভাবে দেখ। যখন আমরা তাকে এরূপে অনুভব করি তখনই আমাদের মনে আসে সমত্ব ও চিরশান্তি। যতদিন এ অনুভূতি না হয় ততদিন দুঃখ আমাদের অনুসরণ করবে। পূজায় আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করিÑ সাধক ক্রমান্বয়ে স্থ’ূল থেকে সূক্ষ্মতত্ত্বের দিকে অগ্রসর হয়। পূজার পূর্বে প্রত্যেকটি উপাচার শুদ্ধ করে নিতে হয়। যে ফুল দিয়ে তার পূজা হবে তাও বিষ্ণুময় চিন্তা করতে হয়। মানস পূজায় আমরা দেখতে পাই, হৃদপদ্মে সুধা সমুদ্রের রতœদ্বীপে কল্প বৃক্ষমূলে ইষ্ট দেবতার আসন। সহস্র কমলদল নিঃসৃত সুধারূপ অমৃত তার শ্রীচরণে পাদ্য, মনকে অর্ঘ্য, তেজতত্ত্বকে দীপ, সুধাসমুদ্রকে নৈবেদ্য, অনাহত ধ্বনিকে ঘণ্টা ও বায়ুতত্ত্বকে গন্ধ, চিত্ত পুষ্প, পঞ্চপ্রাণকে ধূপ, সুধাসমুদ্রকে নৈবেদ্য ও বায়ুতত্ত্ব চামররূপে নিবেদন করার বিধি রয়েছে। পরে ধ্যানের পুষ্পটি সাধকের হৃদয়ে দেবতাকে অভিন্ন কল্পনা করে প্রতীকে বা ঘটে স্থাপন করা হয়। পূজার পরে সংহার মুদ্রায় সেই দেবতাকে পূজক নিজ হৃদয়ে স্থাপন করেন। হিন্দুরা মূর্তিতে দেবতাকে আবাহন করে সেই ঈশ্বরের দেবময় প্রকাশকে পূজা করেন। হিন্দুরা জলকে মহাপবিত্র মনে করেন; তাই জলে প্রতিমা বিসর্জন দেন। এই জল ছাড়া জীবজগতের এক মুহূর্তও চলে না। পূজারীতিতে প্রধানত প্রদীপ, অর্ঘ্যসহ জলপূর্ণ শঙ্খ, বস্ত্র, পুষ্প ও চামর দিয়ে আরতি হয়। যে অনাহত ধ্বনিরূপ ঘণ্টা বাজানো হয়, তা নাদ বা শব্দব্রহ্মের প্রতীক। পূজার মধ্যে যে হোম বিধি রয়েছে তা হচ্ছে আমাদের পূজারূপ কর্ম ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদান করা। শান্তিপাঠ ও শান্তিজল গ্রহণে যে মন্ত্র তাতে সমগ্র বিশ্ববাসী, জড়, জীব, উদ্ভিদ, প্রাণী সকলের জন্য শান্তি কামনা করা হয়। সকলকে আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়। সর্বজনীনতা পূজার একটি বিশেষ দিক। কারণ, যিনি কেবল পূজকের আসনে বসে মায়ের অর্চনা করেন তিনি পূজারী নন। সামগ্রিক অর্থে যিনি মায়ের ভোগ রান্না করেন, যারা পূজাঙ্গন পরিষ্কার রাখেন; সকলে তারই সন্তান, সকলেই তার পূজারী। সকলে কোন না কোনভাবে তার পূজার পূর্ণতা সাধনে সচেষ্ট থাকেন। হিন্দুর পূজাপদ্ধতি মূলত ব্রহ্মসাধনেরই একটি সহজতর প্রক্রিয়াবিশেষ। স্বতঃবিক্ষিপ্ত মনকে একটি ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে এককেন্দ্রিক করার সুচতুর কৌশল ভিন্ন অন্য কিছু নয়। সাধকের জীবন কর্মচঞ্চল। কর্মের মধ্যে তার জ্ঞানের উন্মেষ হয়ে থাকে পরবর্তী অবস্থায়। কিন্তু যেখানে সাধক পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, ইষ্টলাভে বিফল মনোরথ হয়ে যান এবং হতাশ প্রাণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন, ফলে উন্নততর ভূমি পেতে প্রার্থনা জানিয়ে থাকেন তাকে কাতরে। জাগতিকভাবে যখন সন্তান খেলনা নিয়ে ভুলে থাকেন তখন মা কাছে আসেন না। যখন তার খেলনা ভাল লাগে না তখনই কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায় এবং মা সমস্ত কাজ ফেলে এসে কোলে নেন। তেমনই যখন আমরা এ বিশ্বজগতে সবকিছু নিয়ে মেতে থাকি তখন মায়ের দেখা পাই না। নিষ্কামভাবে সবকিছু করতে পারলে মায়ের দেখা পাওয়া যায়। ‘যখন যেভাবে মা গো রাখিবে আমারে, সেই সে মঙ্গল যদি না ভুলি তোমারে।’ লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ, বিষ্ণুপুর, কলকাতা
×