ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মান্না-মাহি চৌধুরীর ফোনালাপে সব ফাঁস

কামালের নেতৃত্বে ঐক্য বিএনপি-জামায়াতের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৮

  কামালের নেতৃত্বে ঐক্য বিএনপি-জামায়াতের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশের ‘সকল সঙ্কট’ সমাধানের ঘোষণা দিয়ে হঠাৎ ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে হাজির হওয়া ড. কামাল বিশেষ কিছুর আশায় এক মাসের মধ্যেই জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী ইস্যুতে ইউটার্ন নিয়েছেন! বিএনপির সমর্থনে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আশায় এখন স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াত নিয়ে ড. কামাল ও তার নেতৃত্বের জোটের আর কোন আপত্তি নেই। এতদিন সরকার এ ঐক্যকে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বলে অভিযোগ করলেও এবার জামায়াত যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে দুই পক্ষের বিরোধেই বেরিয়ে পড়ছে আসল চেহারা। নানা নাটকীয়তার মধ্যে ঐক্যের উদ্যোক্তাদের বয়ানই বলে দিচ্ছে, ক্ষমতার স্বাদ পেতে ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য এখন বিএনপি-জামায়াত মদদপুষ্ট একটি রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়তে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন গত এক মাস আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিষয় দলটির ব্যক্তিগত যা জোটের বিষয়ে আসবে না। শর্ত হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছিল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়েও। ড. কামাল শর্ত দিয়ে বলেছিলেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে বিএনপির। জামায়াতে ইসলামী থাকলে সেই জোটে থাকবেন না বলেও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন ড. কামাল। ড. কামালও ওইসময় ঐক্যে থাকা ডাঃ এ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমরা বিএনপিকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছি, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনভাবেই জোট করবে না। ড. কামালের দ্বিতীয় শর্তে উল্লেখ করা হয়েছিল, বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জোটগতভাবে করা যাবে না। এ বিষয়ে জোট কিংবা ড. কামালকে কোনভাবেই জড়ানো যাবে না। তৃতীয় শর্তের বিষয়ে বলা হয়েছিল, জোটগতভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া যাবে না। এর সঙ্গে জোটের কোন সম্পর্ক থাকবে না। গণফোরামের পক্ষ থেকে বিএনপির তিন শীর্ষ নেতাকে সাত দফা লিখিতভাবে দেয়া হয়েছিল। তবে এক মাস না যেতেই দেখা যাচ্ছে ড. কামাল হোসেন বিএনপির নেতৃত্বে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী দল ও সংগঠনকে দূরে ঠেলতে রাজি নন। তবে শনিবার নানা নাটকীয়তার মধ্যে ড. কামালের নেতৃত্বে বিএনপি ছাড়াও কয়েকটি ক্ষুদ্র দলের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্প ধারার আলাদা সংবাদ সম্মেলনেই উত্তর মিলেছে জোটের নামে আসলে কি হচ্ছে। বিএনপি নেতাদের পাশে রেখে ড. কামাল, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর মান্না যে ঐক্যের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দিয়েছেন তাতে কোথাও নেই জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে আপত্তির কথা। বিএনপির জন্যও নেই খালেদা জিয়া, তারেকের মুক্তির দাবির ইস্যু ও যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে আসার কোন শর্ত। বরং মাহমুদুর রহমান মান্না যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন তাতে আদালতের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত হওয়া খালেদা জিয়াকে বলা হয়েছে ‘রাজবন্দী’। নির্বাচনের জন্য সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের আলোচনার শর্ত দিয়ে কি এ জোট জামায়াতের সঙ্গে আলোচনার বিষয় তুলছে কী না সেই প্রশ্নও সামনে চলে আসছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর জামায়াত ছাড়া দেশের কোন রাজনৈতিক দল সকল দলের সঙ্গে আলোচনার আবদার করেনি। বরং প্রতিটি দল ও সংগঠন দাবি করেছে আলোচনা হতে হবে , সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। এমনকি এক মাস আগেও ড. কামালের নেতৃত্বে গণফোরাম ঘোষণা করেছে, ‘সকল নিবন্ধিত’ দলের সঙ্গে সংলাপ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের করতে হবে। জোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আগেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, বি চৌধুরী বিএনপিকে সমর্থন ও জামায়াত ইস্যুতে ছাড় না দেয়ায় ড. কামাল ‘বিশেষ কিছু’র আশায় ইউটার্ন নিচ্ছেন। বিএনপির সমর্থনে ক্ষমতা এমন কি প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বাদ পাওয়ার আশায় জামায়াতসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ স্বাধীনতা বিরোধী দল নিয়ে ড. কামালসহ তার সঙ্গীদের এখন আপত্তি নেই। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, জামায়াতকে ছাড়তে হচ্ছে না বিএনপির। এমনকি এ ঐক্যে স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রবাদী আরও দল এখন একাকার। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে গবর্নর আবদুল মোতালেব মালেকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্য মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের যুক্ত থাকছেন জোটের আলোচনায়। গেল মাসে মহানগর নাট্যমঞ্চে বিএনপিকে নিয়ে যে সমাবেশ হয়েছিল সেখানেও মঞ্চের প্রথম সারিতে ছিলেন আহমদ আবদুল কাদের। মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে দ-িত নেতার দলকে সঙ্গে নিয়েই হয়েছে ঐক্য। মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে গ্রেফতারের পর ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। ১৯৭৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলার বাণী পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম ‘দালাল মন্ত্রী ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড’। এই নেতা ও তার দল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আসছেন ঐক্যের আলোচনাতেও। বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক হয়ে ঐক্যের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন হেফাজতের ঢাকা মহানগরের আমীর নূর হোসেন কাসেমী। যার একটি রাজনৈতিক দলও আছে। উগ্রবাদী কর্মকান্ডের দায়ে অভিযুক্ত এ দল আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে। এই দলটির সঙ্গে আছে জামায়াতের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এই জোটের আলোচনার শুরু থেকেই ছিল জামায়াত প্রসঙ্গ। আপত্তি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে নিয়ে। কিন্তু ঐক্যের আলোচনায় মধ্যস্থতা করা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপিপন্থী বুদ্ধীজীবী ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটি কৌশলও বের করেন, যেটি মেনেই শেষমেশ ঐক্য হয়। জাফরুল্লাহর কৌশলটা ছিল এমন- বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকবে জামায়াতের সঙ্গে, আর জাতীয় ঐক্য হবে বিএনপির সঙ্গে। ফলে এখানে জামায়াত কোন বিষয় নয়। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেয়া নেতাদের কেউই জামায়াতের প্রসঙ্গটি নিয়ে টু শব্দও করেননি। ঐক্য ফ্রন্টের সংবাদ সম্মেলনের শেষে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে প্রশ্ন রাখলে তিনি বলেন, এসব নিয়ে এখন কথা বলার সময় নেই। তবে ড. কামাল, আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্না কিছু এখন উল্টো পথে হাঁটলেও কথিত এ ঐক্যের আসল চেহারা ফাঁস করে দিয়েছেন ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা। দলের মহাসচিব মেজর (অব) মান্নান ও একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে মাহি বি চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলন ও ফঁাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপই বলে দিচ্ছে ঐক্যের উদ্দেশ্য। ঐক্যের বাইরে গিয়ে আলাদা সংবাদ সম্মেলনে বি চৌধুরী, মাহি বি চৌধুরী ও এম এ মান্নান বলে দিয়েছেন, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর জন্য বিকল্পধারা বাংলাদেশ কোন চক্রান্তে সম্পৃক্ত হবে না। বিকল্পধারার সভাপতি ডাঃ একিউএম বদরুদোজ্জা চৌধুরী একই সঙ্গে ড. কামালের বিরুদ্ধে এক মাস আগে দেয়া সরাসরি জাতীয় ঐক্যের শর্ত ভাঙ্গার অভিযোগ এনেছেন। মহাসচিব মেজর (অব) এম এ মান্নান বলেছেন, আজকের পর থেকে জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপির সঙ্গে কোন বৈঠকে বসে জাতিকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ বিকল্পধারা দেবে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গ ত্যাগ করে জাতীয় সংসদে ভারসাম্যের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাচার মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় শুধু বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর জন্য কোন চক্রান্তে সম্পৃক্ত হবে না বিকল্প ধারা। এখানেই শেষ নয়। বিএনপি নেতাদের পাশে বসিয়ে ড. কামাল, আ স ম রব ও মান্নার ঐক্যের ঘোষণার সংবাদ সম্মেলন ও এর পেছনের এজেন্ডা বেরিয়ে পড়েছে শনিবার রাতে মাহমুদুর রহমান মান্না ও মাহি বি চৌধুরীর টেলিফোন আলাপে। যেখানে মাহি বি চৌধুরীর পক্ষ থেকে ঐক্যের জামায়াত নিয়ে এজেন্ডা বাস্তবায়নসহ নানা অভিযোগ তোলা হলে সদুত্তর দিতে পারেননি মান্না। বরং ঐক্যের কর্মকা-ে নিজেই বিব্রত বলে বলতে শোনা গেছে মান্নাকে। ফোনালাপে বিকল্প ধারাকে পাশ কাটিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ ঘোষণার প্রক্রিয়াকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’ বলেও আখ্যা দেন মাহি। বলেন, জামায়াতকে নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মান্নাকে উদ্দেশ্য করে মাহি বলেন, সকাল থেকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সাহেব কামাল হোসেন সাহেবকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ওনার বাসা থেকে। এ চিন্তাটা আগেই ছিল মওদুদ সাহেবের যে- বি চৌধুরী ও কামাল হোসেনকে একলা বসতে দেয়া যাবে না। এবং বি চৌধুরীকে অপমান করলেন। এই যে একটা পরিকল্পনা, এই একটা চক্রের মধ্যেতো আপনারা পড়ে গেলেন মান্না ভাই। আলাপে পরিষ্কার হয়ে যায়, ঐক্য প্রক্রিয়ায় ড. কামালসহ অন্যরা নিতে চাননি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। মাহির কথা মেনেও নেন মান্না। মান্না বলেন, আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট। আপনি আসলে রাইট কথা বলেছেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে...দ্যাট টাইম ইওর ফাদার সেভড মি। সেটা আমি ভুলছি না।... তার মানে গ্রেটার ইউনিটির বাইরে চলে গেছে, তাতো না। মান্নার বক্তব্যে ড. কামালকে ইঙ্গিত করে মাহি বলেন, কিসের গ্রেটার ইউনিটি? কার সঙ্গে, যে লোক ভদ্রতা জানে না তার সঙ্গে? মান্না: এরকম পলিটিকসে অজস্র হয়...। এরপর মাহি বলেন, না মান্না ভাই, আমরা সে রকম পলিটিকস করি না মান্না ভাই। আমি মনে করি- আপনি, রব চাচা, আপনারা সবাই মিলে একটা কন্সপিরেসির শিকার হয়ে গেলেন। আল্লাহর রহমতে আমরা সেখান থেকে বাঁইচা গেলাম। মাহি স্পষ্ট করে বলে দেন, কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। ওনার নেতৃত্বে জামায়াতের সঙ্গে গোপনে আঁতাত হবে, সেগুলোর সঙ্গে আমরা থাকতে চাই না তো। আলহামদুলিল্লাহ...আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্য করেন। কারা-কারা বি চৌধুরী ও কামাল হোসেনকে আজকে একসঙ্গে বসতে দিল না। মান্নাও স্বীকার করেন, আপনার কথার পর বলব যে, একটা বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম।...
×