ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে এলএনজি

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে এলএনজি

শিল্পায়নে জ্বালানির যে অপ্রতুলতা বর্তমান সরকারের এলএনজি উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তার নিরসন ঘটবে। উৎপাদনমুখী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত গ্যাস সঙ্কটে ভুগছে। কখনও বা শ্রমিকদের অলস বসিয়ে রাখতে হয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই চাহিদামতো গ্যাস বা বিদ্যুত পাচ্ছে না। অনেকে আবার আবেদন করে রেখেছে। এর ফলে প্রতিদিন উৎপাদন কম হচ্ছে যা জাতীয় আয়ে যুক্ত হতে পারছে না। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের একটি বড় জায়গা তৈরি হতে পারছে না। তাই সবদিক বিবেচনায় জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি বাঞ্চনীয়। এবার এলএনজির সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। এলএনজি আলাদা কোন জ্বালানি নয়, এটি প্রাকৃতিক গ্যাসেরই তরল রূপ। প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। শীতলকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের তাপমাত্রা কমিয়ে -১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে আনলে গ্যাস তরলে পরিণত হয়। এই তরল প্রাকৃতিক গ্যাসকেই এলএনজি বলা হয়। এলএনজির প্রধান উপাদান হচ্ছে মিথেন। প্রাকৃতিক গ্যাসকে এলএনজিতে রূপান্তরিত করার সময় মিথেন বাদে অন্যান্য উপাদান যেমন ধূলিকণা, এসিড গ্যাস, হিলিয়াম, পানি, অপেক্ষাকৃত ভারি হাইড্রোকার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি দূর করা হয়। যার কারণে অন্য অনেক জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে এলএনজি ব্যবহারে দূষণ কম হয়। এলএনজির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, যখন প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণ বায়ুম-লীয় চাপে তরল করে ফেলা হয়। তখন এর আয়তন কমে যায় প্রায় ৬০০ গুণ। অর্থাৎ ৬০০ লিটার গ্যাসকে এলএনজিতে রূপান্তরিত করে মাত্র এক লিটারের ছোট্ট একটা বোতলে ভরে ফেলা যায়। এ জন্যই এলএনজি জাহাজে পরিবহন করা সুবিধাজনক। একসঙ্গে অনেক বেশি জ্বালানি পরিবহন করা যায় পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। এলএনজি সরবরাহ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসের উত্তোলন থেকে আরম্ভ করে এলএনজিতে রূপান্তর, সামুদ্রিক পরিবহন, পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর এবং বণ্টন- এই পুরো প্রক্রিয়াকে বলা হয় এলএনজি যোগান শৃঙ্খল (ইংরেজী খঘএ ঝঁঢ়ঢ়ষু ঈযধরহ)। এই শৃঙ্খলের ধাপগুলো হচ্ছে- প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান, আহরণ ও যোগান, এলএনজি উৎপাদন ও সংরক্ষণ, এলএনজি পরিবহন, সংরক্ষণ ও পুনঃগ্যাসিকরণ, গ্যাস বণ্টন/বিপণন। প্রথম তিনটি সংঘটিত হয় এলএনজি বিক্রেতার পক্ষ থেকে। পরিবাহিত এলএনজি ক্রেতার রিসিভিং টার্মিনালে পৌঁছালে পুনঃগ্যাসিকরণ ও বণ্টনের দায়িত্ব ক্রেতার নিজের। এলএনজি শৃঙ্খলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল দুটি ধাপ হচ্ছে এলএনজি উৎপাদন ও পরিবহন। একটি এলএনজি উৎপাদন পয়েন্টে এক বা একাধিক স্বয়ংসম্পূর্ণ তরলীকরণ ইউনিট থাকে, যাদেরকে এলএনজি ট্রেন বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এলএনজি ট্রেন কাতারে অবস্থিত। একটি ট্রেন কিংবা পয়েন্টের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতাকে এমএমটিএ (মিলিয়ন টন পার এনাম) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কাতারগ্যাস অপারেটিং কোম্পানির (ছধঃধৎমধং) সাম্প্রতিককালে নির্মিত দ্বিতীয় সাইট কাতারগ্যাস (ওও) পয়েন্টে দুটি এলএনজি ট্রেন আছে যাদের প্রত্যেকটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭.৮ মিলিয়ন টন। পৃথিবীর অন্যান্য বৃহৎ এলএনজি ট্রেনের মধ্যে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে আটলান্টিক এলএনজি নির্মিত ট্রেন-৪র্থ-এর উৎপাদন ক্ষমতা ৫.২ এমএমটিএ, এবং মিসরে অবস্থিত সিগ্যাস এলএনজি পয়েন্টের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ এমএমটিএ। বাংলাদেশ সরকারের গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১৭ অনুযায়ী, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (এলএনজির হিসাবে যা দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন টন)। ২০১৮ সালে গ্যাসের মোট চাহিদার ১৭ ভাগ এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে, যা ২০২৩ সালে দাঁড়াবে ৪০ ভাগ, ২০২৮ সালে দাঁড়াবে ৫০ ভাগ এবং ২০৪১ সালে দাঁড়াবে ৭০ ভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেই হিসাবে ২০৪১ সালে এলএনজি আমদানির পরিমাণ প্রতিবছর ৩০ মিলিয়ন টন হতে পারে। জ্বালানিবিষয়ক পরামর্শ ও গবেষণা ব্যবসায়ী কোম্পানি উড ম্যাকেঞ্জি ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২০,২০২৫ ও ২০৩০ সালে প্রতিবছর বাংলাদেশের এলএনজির চাহিদার পরিমাণ হবে ৪ মিলিয়ন টন, ৮ মিলিয়ন টন ও ১১ মিলিয়ন টন। এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পাশাপাশি কাতারের তেল ও গ্যাস মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে বর্তমানে মধ্যমেয়াদী চুক্তিতে এবং খোলাবাজারেও (স্পট মার্কেটে) প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পর্যাপ্ত এলএনজি সহজলভ্য। এছাড়া ১৩ জুন ২০১৭ সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক অঝঞজঅ ঞৎধহংপড়ৎ ঊহবৎমু, অঙঞ ঞৎধফরহম অএ-এর সঙ্গে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে এই সমঝোতা স্মারক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন পেট্রোবাংলার সচিব সৈয়দ আশফাকুজ্জামান ও এওটি কোম্পানির এলএনজিবিষয়ক গ্লোবাল হেড জেমস ও’ব্রায়ান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীম পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ, এওটি ট্রেডিংয়ের হেড অব কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স মার্টিন ফেসার, ঢাকায় সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান ক্রিস্টফ ফাস। জেমস ও’ব্রায়ান বলেন, জ্বালানি খাতকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সরকার ইতোমধ্যে এ খাতের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। আজকের এই চুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক বলেও উল্লেখ করেন তিনি। জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় এই সমঝোতা চুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেও মত দেন তিনি। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেছেন, নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয়ে এওটি আমাদের সহযোগিতা করবে। এছাড়া বাংলাদেশে গ্যাসের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে আজকের এই চুক্তি স্বাক্ষর ফলপ্রসূ হবে। চুক্তির ফলে এওটির মাধ্যমে এলএনজি আমদানির একটি পথ সুগম হলো। দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে গত ১৮ আগস্ট প্রথমবারের মতো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের কাজ শুরু হয়েছে। আপাতত শুধু চট্টগ্রামে এই গ্যাস সরবরাহ করা হবে। পাইপলাইনের কাজসহ সবধরনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি শেষ হলে জাতীয় গ্রিডেও সরবরাহ শুরু হবে। এর মাধ্যমে এলএনজি যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খায়েজ আহম্মদ মজুমদার জানান, প্রতিদিন আপাতত ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট করে এলএনজি সরবরাহ করা হবে। নতুন প্রযুক্তি হওয়াতে ধীরে ধীরে সবরবাহ বাড়ানো হবে। টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস আনতে মহেশখালী-আনোয়ারা ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনতে আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলছে। এজন্য কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে রিভার ক্রসিং করতে হবে। ২০১৬ সালে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত ও তাইওয়ান ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানিকারক প্রথম পাঁচটি দেশ। এছাড়া আমাদের অঞ্চলে পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড তাদের জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি করে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ সালের মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ যদি ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হতে চায়, তবে আগামী ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ হতে হবে। এর অর্থ, আরও দ্রুত শিল্পায়ন ও জ্বালানি চাহিদা বৃদ্ধি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত দুই অর্থবছরে ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাতওয়ারি অবদানেরও পরিবর্তন এসেছে। গত তিন দশকে জিডিপিতে খাতওয়ারি অবদানের হার হিসাব করলে দেখা যায় যে অতীতে (আশি বা নব্বইয়ের দশকে) কৃষি ক্ষেত্রের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি (শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ)। শিল্প ক্ষেত্রে তখন অবদান ছিল কম (১০ থেকে ১৫ ভাগ)। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসে দেখি, জিডিপিতে কৃষি ক্ষেত্রের অবদান দাঁড়িয়েছে ১৫ ভাগের কম আর শিল্প ক্ষেত্রের অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশ। শিল্পক্ষেত্রে জ্বালানি চাহিদা কৃষি বা অর্থনীতির অন্যান্য খাতের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণভাবেই এটা বোঝা যায় যে দেশে জ্বালানি চাহিদা বাড়ার প্রধান কারণ দেশের বিদ্যুতায়ন ও শিল্পায়ন, তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সমোদয় জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই হবে।
×