ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অদম্য ক্যানান সিংহদের এগিয়ে চলা...

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

অদম্য ক্যানান সিংহদের এগিয়ে চলা...

রুমেল খান ॥ ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন নামটি নামেই এক দুঃখের দীর্ঘশ্বাস, এক নির্যাতন আর বঞ্চনার ইতিহাস। মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখ- যা ভূমধ্যসাগর ও জর্দান নদীর মাঝে অবস্থিত। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাÑ এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে দেশটি। এটি ইহুদী ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের জন্মস্থান। ভৌগোলিক অবস্থান ও দুটি প্রধান ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিন নামক ভূখ-টির রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির এক দীর্ঘ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। ফিলিস্তিনের আরও কিছু নাম আছে। যেমন ক্যানান, জায়ান, জুন্দ ফিলাস্তিন এবং পবিত্র ভূমি। ফিলিস্তিন অঞ্চলটি পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চলগুলোর একটি যেখানে মানুষের বসবাস, কৃষিনির্ভর জনসমষ্টি এবং সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের প্রথম ও মধ্যভাগে স্বাধীন ক্যানানীয় নগর-রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল এবং প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, ফোয়েনেশিয়া, মাইনোয়ান ক্রিট এবং সিরিয়ায় গড়ে ওঠা সভ্যতা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০,৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেনবিরোধী জোটে, তখন যুদ্ধ জয়ে ফিলিস্তিনীদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন যা ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত। যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদীদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়। কিন্তু এর মাঝে যে মহাধোঁকাটি লুকিয়ে ছিল তা তারা বুঝতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তেরি করতে সক্ষম হন ইহুদী বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। ফলে আনন্দিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন কি ধরনের পুরস্কার তিনি চান। উত্তর ছিলÑ ‘অর্থ নয়, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন। ফলে ফিলিস্তিন ভূখ-টি ইহুদীদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরবশূন্য করার জন্য ভালভাবে কাজে লাগায় ইহুদী বলয়দ্বারা প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনীদের জোর করে নিজেদের ভূখ- থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে পুনর্বাসন করা হয় ইহুদীদের। ওই বছরই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। সেই থেকে নিজেদের ভূখন্ড ফিরে পেতে লড়ে যাচ্ছে হতভাগ্য ফিলিস্তিনীরা। তারা যেন নিজ ভূমে পরবাসী। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইসরাইল নিপীড়ন ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনীদের ওপর। তাদের অল্প কিছু যা ভূখ- আছে তার ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ চালিয়ে হত্যা ও গুম করছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে। এর মধ্যেই ফিলিস্তিনীরা চালিয়ে যাচ্ছে ফুটবল খেলা। যদিও তাদের বেশিরভাগ সময়ই অনুশীলন করতে হয় বিদেশের মাটিতে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন আজ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের ১০০ নম্বরে। আর তাদের চিরশুত্রু ইসরাইলের র‌্যাঙ্কিং ৯৪ যারা কিনা শতভাগ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সে তুলনায় ফিলিস্তিনের নৈপুণ্য বেশ আশাব্যঞ্জকই বটে। শুক্রবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শেষ হলো ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা’র খেলা। এতে ফাইনালে ফিলিস্তিন টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে তাজিকিস্তানকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই তাদের ছন্দময়-গতিশীল-পরিচ্ছন্ন খেলা দর্শকদের মন জয় করে নেয়। ফিলিস্তিন গোলরক্ষক রামি হামাদা ফাইনালে দুটি পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে ম্যাচসেরার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন অধিনায়ক-ডিফেন্ডার আব্দাল লতিফ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটি ফিলিস্তিনের চতুর্থ শিরোপা। এর আগে তারা জেতে দু’বার ‘আল নাকবা কাপ’ (২০১২ ও ২০১৪ সালে) এবং ‘এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ’ (২০১৪ সালে)। তারমানে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে চার শিরোপা। বেশ ঈর্ষণীয়ই বলতে হবে। ফিলিস্তিন ফুটবল ফেডারেশনের জন্ম বেশ আগে ১৯২৮ সালে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের অবস্থান ছিল ৭৩তম র‌্যাঙ্কিংয়ে যা তাদের সেরা। এছাড়া ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় এএফসি এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে প্রথমবারের মতো। অফিসিয়ালভাবে ফিলিস্তিন তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই। আলেকজান্দ্রিয়ায় অনুষ্ঠিত সে ম্যাচে অবশ্য তারা ১-৮ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরে যায় স্বাগতিক মিসরের কাছে। তাদের সবচেয়ে বড় জয়টা এই ঢাকার মাটিতেই ১১-০ গোলে। ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল তারা এএফসি কাপের খেলায় ওই ব্যবধানে হারিয়েছিল গুয়ামকে। ফিলিস্তিনের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ফাহেদ আত্তাল (২০০৫-২০১২)। ৪০ ম্যাচে তার গোলসংখ্যা ১৪। ১২ গোল নিয়ে তাকে টপকানোর অপেক্ষায় ২০০৯ সালে শুরু করা আশরাফ নু’মান। ৪৯ ম্যাচে তার গোল ১২টি। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন রামযি সালেহ (২০০০-২০১৫)। তিনি খেলেছেন ৬৯ ম্যাচ। তাকে অতিক্রম করতে পারেন ৬৩ ম্যাচ খেলা খাদের ইউসেফ (অভিষেক ২০০৮ সালে)। শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য ক্যানান সিংহরা তাতে আগামীতে তারা আরও উন্নতি করবে ও সাফল্য পাবে... এমনটা আশা করা যেতেই পারে।
×