ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্যিক কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

বাণিজ্যিক কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূমিকা

বাংলাদেশের কৃষি তার গতানুগতিক রূপ পরিত্যাগ করে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হতে চলেছে। যার ফলে দেশ কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই হচ্ছে না বরঞ্চ রফতানির তালিকায়ও স্থান পাচ্ছে। এই সাফল্যের পেছনে অন্যতম একটি কারণ কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই)সহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল জাত এবং উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি দেশের কৃষিকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমান পৃথিবীতে আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিসমূহের মধ্যে জিএম ফসল উদ্ভাবন একটি সময়োপযোগী পদ্ধতি। কাক্সিক্ষত জাত উদ্ভাবনে চিরায়ত প্রজনন পদ্ধতির (ঈড়হাবহঃরড়হধষ ইৎববফরহম) সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য পৃথিবীব্যাপী বর্তমানে জীব প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে কাক্সিক্ষত জাত পাওয়ার ক্ষেত্রে সময় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৭ পর্যন্ত পৃথিবীর ২৪টি দেশে প্রায় ১৮৯.৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জিএম ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে এবং দিন দিন এর আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিন কৌশল প্রয়োগ করে বিভিন্ন দেশে যেসব ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে তার মধ্যে সয়াবিন, ভুট্টা, তুলা, পেঁপে, আলু, সুগারবিট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে যেখানে জিএম ফসলের অধীনে জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর, ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭০.৩ মিলিয়ন হেক্টর হয়েছে এবং বিগত ২০১৬ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে ১৮৫.১ এবং ১৮৯.৯ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জিএম ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে মিলিয়ন মিলিয়ন হেক্টর জমিতে গম, ভুট্টা, সয়াবিন, কেনোলাসহ বিভিন্ন জিএম ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে। ওই দেশসমূহে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ দূষণসহ জিএম ফসল চাষাবাদের প্রতিটি দিক নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণাও পরিচালনা করা হয়ে থাকে এবং এখন পর্যন্ত এর ক্ষতিকর প্রভাব উদ্ঘাটিত হয়নি। যে কারণে জিএম ফসলের চাষাবাদ প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও জিএম ফসলের ওপর ২০০৫ সাল হতে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা হয়। মূলত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সবজি বেগুনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যাপক অপব্যবহার হ্রাসের জন্যই বিটি বেগুনের গবেষণা শুরু করে। বেগুনে বেশ কয়েক ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করলেও এর প্রধান শত্রু ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা। গবেষণার তথ্য মোতাবেক কেবল এ পোকার কারণে ক্ষেত্র বিশেষে বেগুন ফসলের শতকরা ৮৫ ভাগ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশের কৃষকেরা ওই শত্রু পোকা দমনের জন্য প্রতি ২-৩ দিন অন্তর (এক মৌসুমে ৮০-১৬০ বার পর্যন্ত) জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। বেগুনচাষীগণ এ পোকা দমনের জন্য মোট উৎপাদন ব্যয়ের শতকরা প্রায় ৩২-৪০ ভাগ পর্যন্ত রাসায়নিক কীটনাশকের পেছনে খরচ করেও কাক্সিক্ষত ফল পায় না। ওই বিষয়সমূহ বিবেচনা করে দীর্ঘ গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এবং দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে বিটি বেগুনের জাত অবমুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে ডগা ও ফলছিদ্রকারী পোকার আক্রমণের হাত থেকে দেশের আপামর বেগুনচাষীগণ মুক্তিলাভ করার পথ খুঁজে পেয়েছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জেনেটিক মডিফিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক কিছু আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশেও বায়োসেফটি রুলস, বায়োসেফটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে যার আলোকে এনটিসিসিবি (ঘধঃরড়হধষ ঞবপযহরপধষ ঈড়সসরঃঃবব ড়হ ঈৎড়ঢ় ইরড়-ঃবপযহড়ষড়মু) ও পরবর্তীতে এনসিবির (ঘধঃরড়হধষ ঈড়সসরঃঃবব ভড়ৎ ইরড়ংধভবঃু) সুপারিশক্রমে বিগত ৩০ অক্টোবর, ২০১৩ খ্রি. তারিখে বিটি বেগুনের ৪টি জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। বিটি বেগুন অবমুক্ত করার বিষয়ে অনেকে অভিযোগ করেন এটি তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যা মোটেও সঠিক নয়। ২০০৫ সালে বিটি বেগুনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় এবং দীর্ঘ আট বছর পর এটি অবমুক্ত হয়। বিটি বেগুন উদ্ভাবনের জন্য বায়োটেকনোলজিস্ট, উদ্ভিদ প্রজননবিদ, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ও কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম ৮ বছর যাবত সম্পূর্ণভাবে বায়োসেফটি রুলস অনুসরণ করে গবেষণা সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে পরিবেশ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে এবং বায়োসেফটি কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে এবং বায়োসেফটি নিয়ম অনুসরণ করে ২০০৮-২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএআরআই-এর ৭টি গবেষণা কেন্দ্রে (জয়দেবপুর, জামালপুর, যশোর, হাটহাজারী, বরিশাল, ঈশ্বরদী ও রংপুর) বিটি বেগুনের উপর বহুস্থানিক পরীক্ষা কার্য পরিচালনা করা হয়। ওই গবেষণাসমূহের ফলাফলের ভিত্তিতে এবং দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে ও বায়োসেফটি রেগুলেশন অনুসরণ করে বিটি বেগুনের জাতসমূহ মুক্তায়িত করা হয়। অবমুক্তকৃত বিটি বেগুনের জাতসমূহ বর্তমানে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। সম্প্রতি এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, সাধারণ বেগুনের তুলনায় বিটি বেগুন চাষে কীটনাশকের খরচ ৬১ শতাংশ সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে সকল প্রকার প্রজনন পদ্ধতির মধ্যে জিএম (এবহবঃরপধষষু গড়ফরভরবফ) পদ্ধতি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এর কোন ধরনের অপ্রত্যাশিত ও অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি পাওয়া যায়নি যা মানব স্বাস্থ্য, জীবজন্তু কিংবা পরিবেশের জন্য কোন কুফল বয়ে আনতে পারে। অতি সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মানের ঈঙঠঅঘঈঊ ল্যাবরেটরিতে বাংলাদেশের বিটি বেগুনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বিটি বেগুন ও ননবিটি বেগুনের মধ্যে কোন পার্থক্য পাওয়া যায়নি এবং প্রাণীদেহে বিটি বেগুনের কোন ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। জিএমও ফসল বিটি বেগুনের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকেই করে থাকেন, যেটিও সঠিক নয়। দেশের প্রচলিত যে ৯টি বেগুনের জাতে বিটি জিন প্রবেশ করানো হয়েছে তার মালিকানা এবং সার্বিক নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট তথা সরকারের কাছেই রয়েছে। বিটি বেগুন কোন হাইব্রিড জাত নয় বিধায় কৃষকরা নিজেরাই এ বেগুনের বীজ উৎপাদন ও পরবর্তী বছর চাষের জন্য তা ব্যবহার করতে পারবেন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বীজ উৎপাদন ও বিপণনে কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। বিটি বেগুন দেশে অবমুক্ত হওয়ার পর থেকে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাত হিসাবে মুক্তায়িত করার পর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ২০১৩-১৪ সালে ৪টি জেলায় ২০ জন, ২০১৪-১৫ সালে দেশের ১৯টি জেলায় ১০৮ জন, ২০১৫-১৬ সালে ২৫টি জেলায় ২৫০ জন, ২০১৬-১৭ সালে ৩৬টি জেলায় ৫১২ জন এবং ২০১৭-১৮ সালে ৪৮টি জেলায় ৫৬০ জন কৃষকের মাঠে বিটি বেগুনের জাতগুলোর উপযোগিতা যাচাই করা হয়। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী ২০১৬-১৭ সালে প্রায় ৫০০০ জন কৃষকের মাঠে, ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ৭৬০০ জন কৃষকের মাঠে বিটি বেগুনের প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়। স্থাপিত প্রদর্শনীগুলোর উৎসাহব্যঞ্জক ফলাফল কৃষকদের বিটি বেগুন চাষে অনুপ্রাণিত করে। একবার কোন কৃষক বিটি বেগুন চাষ করার পর তার সাফল্যে আশপাশের কৃষকগণও উৎসাহিত হয়ে বীজ সংগ্রহ করে বিটি বেগুন চাষ করছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত রিপোর্টও প্রকাশিত হচ্ছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ খ্রি: দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিটি বেগুনের পর এবার তুলা আলু ধান নিয়েও গবেষণা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিটি বেগুন চাষ সম্পর্কে কয়েকজন চাষীর মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার আমতলীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম নিজের ২৫ শতাংশ জমিতে ৩ বছর ধরে বিটি বেগুন চাষ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন ‘পোকার কারণে অন্য বেগুনের ৮০ শতাংশই নষ্ট হলেও বিটি বেগুনে একটাও পোকা খুঁজে পাওয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই এলাকায় আমিই প্রথম বিটি বেগুন আবাদ করেছি। এখন আমার দেখাদেখি অনেকেই বিটি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। তবে তাদের আমি বীজ দিতে পারছি না।’ বিটি বেগুনের স্বাদ ও জনপ্রিয়তার কথাও এ কৃষক জানিয়েছেন ‘বিটি বেগুন আমরা প্রায় প্রতিদিনই খাই। স্বাদের দিক থেকে এর স্বাদ অন্য যে কোন বেগুনের তুলনায় ভাল। আর এই বেগুন বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে গেলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কার আগে কে নেবে- শুরু হয় সেই প্রতিযোগিতা।’ সুতরাং অনেক সময় বিটি বেগুনকে যে বিকৃত বেগুন হিসেবে উল্লেখ করা হয় তা একদিকে যেমন বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিহীন অন্যদিকে কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়েও অন্তসারশূন্য। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারসহ বিভিন্ন সময়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। দেশের কৃষি ও কৃষকের মঙ্গল সাধনায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সর্বদাই সচেষ্ট রয়েছে এবং ভবিষতেও থাকবে।
×