ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় ॥ সত্যের জয় হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার রায় ॥ সত্যের জয় হয়েছে

১৪ বছর আগে সংঘটিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় গত ১০ অক্টোবর প্রদান করেছে আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদ- ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। বাকি ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। মামলাটির মোট ৫২ আসামির মধ্যে ইতোমধ্যে অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় আসামির সংখ্যা ছিল ৪৯ জন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জনই কারাগারে বন্দী। আর যাবজ্জীবন পাওয়া ১৯ আসামির মধ্যে ১৩ জনই পলাতক। মামলাটিতে সাক্ষী ছিল মোট ৫১১ জন। সাক্ষী গ্রহণ করা হয়েছে ২২৫ জনের। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। পৈশাচিক ঐ হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নির্মমভাবে নিহত হন। হায়েনাদের বোমার আঘাতে আহত হন কয়েক শ’ নেতা-কর্মী। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার পর মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা আওয়ামী লীগের ওপর এটাই ছিল জঘন্যতম আঘাত। তবে এই বীভৎস হামলার মূল টার্গেট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হলেও আল্লাহ্র অশেষ রহমতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। প্রাণে রক্ষা পেলেও তাঁর শ্রবণেন্দ্রীয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলার সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী অনেকেই অবিশ্বাস্যভাবে নিজেদের জীবন বাঁচানোর কথা মালুম ভুলে গিয়ে তাদের প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করার জন্য মানববর্ম গড়ে তোলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা। কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, এই ঘৃণ্য হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একযোগে একই জায়গায় শেষ করে দেয়া। সারা বিশ্বে এমন নারকীয় ঘটনার নজির তেমন একটা নেই। তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি ন্যক্কারজনকভাবে হামলার পরপরই সকল আলামত নষ্ট করে ফেলে। যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অনেক আগেই এরকম একটি নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটানো উচিত ছিল। অথচ বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এ সংক্রান্ত মামলা নির্লজ্জভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে নানাভাবে, নানা প্রক্রিয়ায়। অনেক তথ্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। জজ মিয়া নামের এক সরল-সোজা নিরীহ ব্যক্তিকে ধরে এনে তার কাছ থেকে মিথ্যা জবানবন্দী আদায় করে ঘটনার কুশীলব ও রাঘববোয়ালদের আড়াল করার নির্লজ্জ প্রয়াস চালানো হয়েছিল। মামলার তদন্তের নামে তারা প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছিল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল জজ মিয়া নাটক সৃষ্টি। সরকারের ভেতরেই যে হামলাকারীদের শেকড় গভীরভাবে প্রথিত ছিল সে সন্দেহ জোরদার করেছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের কা-জ্ঞানহীন ও বর্বর আচরণ। নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিল একটি বিশাল জনসমাবেশে। একটির পর একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রচ- শব্দে প্রকম্পিত হয়েছিল সভাস্থলসহ আশপাশের এলাকা। ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশের মানুষ। বিক্ষুব্ধ মানুষকে দমন করতে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল মাত্রাতিরিক্তভাবে। সন্ত্রাসীদের নিক্ষিপ্ত আর্জেস গ্রেনেডগুলো এসেছিল পাকিস্তান থেকে। নিরস্ত্র মানুষের ওপর আর্জেস গ্রেনেডের মতো সমরাস্ত্র ভারতসহ এ অঞ্চলে আর কোথায়ও ব্যবহার হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই গ্রেনেড হামলার বিচার শুরু হয়। তদন্ত শুরুর পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে নতুন নতুন তথ্য। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করে। ২০০৮ সালের জুন মাসে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাইজুদ্দিন, জঙ্গী নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৬১ জনের সাক্ষ্য নেয়ার পর ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ব্যাপকভাবে তদন্ত শুরু করে। ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগ দেয় সিআইডি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় দফার তদন্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করে হামলার প্রকৃত নীলনক্সা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ২১ আগস্ট ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পেছনে প্রকৃত সত্য কি তা দেশের মানুষের জানা ছিল অত্যন্ত জরুরী। ১৪ বছরের অধিক সময় পরে হলেও সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের মানুষ জানতে পারল এ ভয়ঙ্কর হামলার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর পরিচয়। জানতে পারল কারা ছিল মূল পরিকল্পনাকারী, আর কারা ছিল ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় অংশ নেয়া দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামি তারেক রহমানের নেতৃত্বে হাওয়া ভবনে বসেই যে ভয়াবহ হত্যাকা-ের পরিকল্পনা করা হয় এবং তা বাস্তবায়নের সব ঘটনাই আজ জনগণ জানতে পেরেছে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেছে এই বলে যে, ‘রাষ্ট্রীয় মদদে এই উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা।’ ‘১৯৭৫ সালের হত্যাকা- ও ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা একই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত।’ বিজ্ঞ বিচারক বলেছেন, রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে এটা কাম্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যে দলই থাকবে বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিক্রিয়ায় রায়কে ফরমায়েশি অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, তার দল মনে করে এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সন্দেহ নেই, মির্জা ফখরুল দেশের একটি বড় দলের মহাসচিব। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি দলটির একজন নিয়োগকৃত বেতনভুক কর্মকর্তা। যে ভাষায় তিনি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তা একেবারেই শেখানো বুলি। তার উপরে অবস্থিত দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলেছেন তিনি ঠিক সেভাবেই জানিয়েছেন। তাতে আমি তার তেমন দোষ দেখছি না। শুধু এটুকুই বলব, আদালত দীর্ঘদিন ধরে অনেকের সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং আসামি ও বাদীপক্ষের বক্তব্য চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং সততার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে ঐতিহাসিক রায়টি প্রদান করেছে। সেই রায়টি যদি ফরমায়েশি বা ক্ষমতাসীন দলের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রয়াস হয়ে যায় তাহলে ২১ আগস্ট ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে দেশের সর্ববৃহৎ দলটির শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী দলটির নাম-নিশানা মুছে ফেলার যে ঘৃণ্য চক্রান্ত তার দলের কুশীলবরা করেছিল তাকে কি বলা যাবে? রাজনীতিবিদদের অনেক সময় প্রয়োজনে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলতে হয়। তাই বলে মিথ্যাচার! সেই মিথ্যাচারেরও একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত নয় কি? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাঁর দলের পক্ষ থেকে বলেছেন, বিলম্বিত হলেও এই রায়ে অমরা অখুশি নই। কিন্তু পুরোপুরি সন্তুষ্টও নই। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি যে, এটা একটা ভাল রায়। রায়ের জন্য আদালতকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, অন্তত একটা বিচার হয়েছে। কিন্তু রায় নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ২১ আগস্টের মাস্টারমাইন্ড, প্ল্যানার ও বিকল্প পাওয়ার হাউসের (হাওয়া ভবন) তারেক রহমান সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে পারতেন। তাই আমরা তারেক রহমানের ফাঁসি দাবি করছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফাঁসি দাবি করছি।’ তিনি বলেন, যে বর্বর তা-ব তারা ঐদিন চালিয়েছিল তা মুফতি হান্নানের জবানবন্দীতে বেরিয়ে এসেছে। হামলার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী না থাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানতেন, আর তিনি (খালেদা জিয়া) জানতেন না, এটা হয় না। তাই খালেদা জিয়াও এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও এ মামলায় বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন। রায় ঘোষণার পর অনেকেই প্রচ- ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ঐ বর্বর হামলায় নিহতদের স্বজন ও হামলায় আহতরা যেভাবে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও দুঃখ-বেদনা প্রকাশ করেছেন তা অনেক মানুষকেই কাঁদিয়েছে। তারা হামলার প্রধান হোতা ও পরিকল্পনাকারী তারেক রহমানের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায়ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এই রায়ে প্রমাণ হয়েছে যে, অন্যায় করে কেউ পার পায় না। তাকে ধরা পড়তেই হয়। বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদেনি। দেরিতে হলেও সত্য সুন্দরের জয় হয়েছে। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×