ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেনেড হামলায় হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা হয় পাকিস্তানে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

গ্রেনেড হামলায় হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা হয় পাকিস্তানে

শংকর কুমার দে ॥ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয় পাকিস্তানে। সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানোর জন্য গ্রেনেড হামলা করানো হয় বাংলাদেশে। এই পরিকল্পনা করে কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন। হিজবুল মুজাহিদিন হচ্ছে পাকিস্তান জামায়াতের সামরিক শাখা। আর্জেস শ্রেণীর গ্রেনেড পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে নিয়ে আসে কাশ্মীরী নাগরিক মাজেদ ভাট। হামলার জন্য গ্রেনেড নিয়ে আসে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঘটনা মনিটরিং করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এরপর সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হয় জঙ্গী সংগঠন হরকাত উল জিহাদের (হুজি) নেতা মাওলানা তাইজউদ্দিনকে। তাইজউদ্দিন জবানবন্দীতে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা শেখ আব্দুস সালাম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়ে আদালতে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে এই তথ্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ শাখার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সালামের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট থানার পেচিবাড়ী গ্রামে। ১৯৮৪ সালে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশুনা করার সময় পাকিস্তান যান তিনি। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতেই সেখানে যায় মাওলানা সালাম। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে সক্রিয় বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যাতায়াতের সময় কখনও পাকিস্তানি পাসপোর্ট, আবার কখনও বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন সালাম। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০০৯ সালের ১ নবেম্বর থেকে গ্রেফতার আছেন তিনি। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর আদালতে জবানবন্দী দেন সালাম। জবানবন্দীতে সালাম বলেছেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনা হয় পাকিন্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে। এই পরিকল্পনা করে কাশ্মীরভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন। সংগঠনটি বাংলাদেশের তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও দলের নেতাকর্মী, প্রশাসন, ধর্মভিত্তিক প্রকাশ্য ও গোপন সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও হামলা বাস্তবায়ন করে। হিজবুল মুজাহিদিন হচ্ছে পাকিস্তান জামায়াতের সামরিক শাখা। ২১ আগস্ট হামলার গ্রেনেড সরবরাহ করে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা আব্দুল মজিদ ওরফে মাজেট ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট। বর্বরোচিত ওই গ্রেনেড হামলার বর্ণনা দিয়েছেন অন্যতম আসামি শেখ আব্দুস সালাম তার জবানবন্দীতে। জবানবন্দিতে সালাম বলেছেন, ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধে অংশ নেই। একে-৪৭ রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নেই। এরপর আরও তিন দফা যুদ্ধ করি। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে ফিরি। হরকাতুল জিহাদের কার্যক্রম শুরু করি। বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম এবং বিশ্বের মজলুম মুসলিমদের মুক্তির সংগ্রামে সহায়তা করাই এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সালের কিছু সময় তৎকালীন সরকারের সহযোগিতায় নির্বিঘেœ সংগঠন পরিচালনা করি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে লালখান বাজার (চট্টগ্রাম) মাদ্রাসা থেকে আমাদের কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া চট্টগ্রামের উখিয়ায় পাতাবাড়ী ক্যাম্প থেকে আমাদের ৪১ জিহাদি ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা হলে বিচারে তাদের যাবজ্জীবন সাজা হয়। এই অবস্থায় সংগঠন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ১৯৯৭ সালে স্ত্রী সন্তানসহ বাংলাদেশী পাসপোর্টে পাকিস্তানে যাই। ২০০২ সালে গফুর পরিচয়ে পাকিস্তানী পাসপোর্টে দেশে ফিরি। বগুড়া শেরপুরে বালিকা মাদ্রাসা স্থাপন করে শিক্ষকতা শুরু করি। এ সময় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সে আমাকে ঢাকায় আসার তাগাদা দেয়। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরের সাত মসজিদে বৈঠকে বসি। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিল বিএনপি ও জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই হিজবুল মুজাহিদিন নেতা মাওলানা তাইজউদ্দিন, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, কাশ্মীরী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট ও মুফতি হান্নান। ওই বৈঠকে মাওলানা তাজ বলেন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ ও ভারতে কর্মকা- চালানো অসুবিধা হয়। কাজেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। বাংলাদেশ ও ভারতে হিজবুল মুজাহিদিন ও অন্যান্য সংগঠনের সুবিধা হবে তাতে। অতএব ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুজাহিদদের হাতে অস্ত্র, গোলাবারুদ তুলে দিতে হলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হবে। জবানবন্দীতে সালাম বলেন, তাইজউদ্দিন জানায়, সে এবং আব্দুল মাজেট ভাট গ্রেনেড ও গোলাবারুদ সরবরাহ করবে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার কারণে উপমন্ত্রী পিন্টু সরকারী সব ধরনের সহযোগিতা দিতে পারবে বলেও মাওলানা তাজ এ সময় জানায়। ২০০৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান থেকে আসা তবলীগ জামাতের সঙ্গে সে দেশে যাই। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের শেষে দেশে আসি। কিছুদিন পর আবারও পাকিস্তান যাই। নিজের মাদ্রাসার জন্য টাকা সংগ্রহ করে দেশে ফিরি। সালাম জবানবন্দীতে বলে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলা ঘটালে পুলিশ আমার খোঁজখবর নেয়। তখন আমি পূর্ব পরিচিত খেলাফত মজলিশ নেতা কাজী আজিজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকায় যাই। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে ডিজিএফআইর ঢাকা ডিটাচমেন্ট কমান্ডার কর্নেল সালামের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে লে. কর্নেল সাইফ, লে. কমান্ডার মিজানসহ আরেকজন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং এই সূত্র ধরেই তারা আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে শুরু হয়। আমি দেশে সংঘটিত বিভিন্ন জঙ্গী কর্মকা- সম্পর্কে তাদের তথ্য সরবরাহ করতে থাকি। এক পর্যায়ে লে. কর্নেল আফজাল, মেজর মনির, লে. কমান্ডার মিজানসহ আরও অফিসারের সঙ্গে পরিচয় হয়। হরকাতুল জিহাদ নেতা শেখ ফরিদ, মাওলানা মনির, মাওলানা সাব্বিরদের নিয়ে ডিজিএফআইর সঙ্গে বৈঠক করি। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলাকারী বিপুলকে ধরিয়ে দিয়ে তাদের সহযোগিতা করি। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নান গ্রেফতার হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা সে স্বীকার করে এবং এর সঙ্গে উপমন্ত্রী পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজের সম্পৃক্ততার তথ্য দেয়। তখন র‌্যাব তাজকে খুঁজছিল। জবানবন্দিতে সালাম বলে, একদিন ডিজিএফআই অফিসে লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়দারের সামনে বসা ছিলাম। এমন সময় তার কাছে ফোন আসে। কথা শেষে সে বলে মাওলানা তাজকে র‌্যাবের কাছে পাঠালে অসুবিধা আছে। এরপর সে তার রুম থেকে বাইরে যায় এবং পরে ফিরে এসে মাওলানা তাজের খোঁজখবর জানতে চায়। আমি বলি, আপাতত খবর নেই, তবে যোগাযোগের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। পরে মাওলানা মনিরের মাধ্যমে তাজের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা একে অন্যের আত্মীয়। তাদের নিয়ে গুলশানে ডিজিএফআইর গেস্ট হাউসে যাই। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে রাতে গেস্ট হাউসেই কাটাই। এ সময় তাজকে জিজ্ঞাসা করি ডিজিএফআই তাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক মনে করে কেন। সে বলে, আমার কিছু ব্যবসা আছে। সেসব নিয়ে সমস্যা হয়েছে। কী ব্যবসা জানতে চাইলে তাজ জানায়, আমরা কিছু মালামাল ভারত পাঠাই। সেগুলো নিয়ে সমস্যা হয়েছে। এক পর্যায়ে তাজ বলে, ভারতে হিজবুল মুজাহিদিনের জন্য টাকা, গুলি ও গ্রেনেড পাঠালে সেগুলো নিয়ে সদস্যা হয়েছে। সে আরও জানায়, কাশ্মীরী নাগরিক মাজেদ ভাট চিটাগাং থেকে গ্রেনেড নিয়ে আসে। পরে আমরা ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। জবানবন্দিতে সালাম বলেন, আব্দুল মাজেদ ভাটের কাছ থেকে পাওয়া গ্রেনেডই ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার সময় ব্যবহার হয়েছে। সে আরও জানায়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বসে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে হিজবুল মুজাহিদিন। ২১ আগস্টের আগের দিন উপমন্ত্রী পিন্টুর বাসায় গ্রেনেড হামলার বিষয়ে যে বৈঠক হয়, সেখানে পিন্টু ছিল, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরও উপস্থিত ছিল বলে তাজ আমাকে জানায়। এরপর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলে তাজকে পাকিস্তান পাঠানো হয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তান ‘৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে পাকিস্তানে। শেখ হাসিনাকে হত্যা করা গেলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন নাÑ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রতিশোধপরায়ন প্রতিহিংসা এখনও থেমে নেই, সুযোগ ও সময় পেলে আবারও আরেকটি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো পরিকল্পনা নিবে এমন আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ২১ আগস্ট যেহেতু ফৌজদারি অপরাধের মামলা তদন্ত হয়েছে, সে কারণে রাজনৈতিক বিষয়গুলো তেমনভাবে সামনে আসেনি বলেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ভূমিকার অনেক কিছুই আড়ালে থেকে গেছে।
×