ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঐক্যে ভাঙ্গনের সুর, কৌশলী অবস্থানে বিএনপি ও ঐক্যের নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৩ অক্টোবর ২০১৮

 ঐক্যে ভাঙ্গনের সুর, কৌশলী অবস্থানে বিএনপি ও ঐক্যের নেতারা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা রায়ের পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ১৪ বছর পর মামলার রায় হয়। রায়ে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান, বাবর-পিন্টুসহ ১৯জনের ফাঁসি ও ১৯জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। অর্থাৎ দণ্ডপ্রাপ্তের বেশিরভাগই সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নির্বাচন সামনে। তাই রায়ে অনেকটা বেকায়দায় বিএনপি। রায়ের কারণে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বিএনপির সঙ্গে কতটুকু ঐক্যে আসবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতারা বিএনপির সঙ্গে ড. কামালদের জাতীয় ঐক্যের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। তারা বলছেন, খুনী দল আর সেই দলের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য হতেপারে না। এরকম ঐক্য দেশের মানুষ মেনে নেবে না। এই প্রেক্ষাপটে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন বিএনপি-যুক্তফ্রন্টসহ জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে শুক্রবার রাতে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ড. কামালদের বৈঠকের কথা থাকলেও তা হয়নি। শুক্রবার রাতে ফের বৈঠকের কথা। কিন্তু বিএনপি ও ঐক্য প্রক্রিয়ার একাধিক সূত্র বলছে, এমনিতে বিএনপি জোটে জামায়াত থাকায় জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে একযোগে পথ চলায় নানা রকমের টানাপোড়েন চলছে। বারবার ঐক্য প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে জামায়াত ছাড়তে বিএনপিকে শর্ত দেয়া হচ্ছে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত বিএনপি ঐক্য প্রক্রিয়ার ওপর ভর করলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে সামনে এসেছে। একদিকে দেশ-বিদেশে বিএনপিকে নিয়ে সমালোচনা। অন্যদিকে ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা। এই অবস্থায় যুগপৎ রাজনৈতিক কর্মসূচী কতটুকু বিতর্কের উর্ধে রাখা যাবে। কতটুকুইবা সাধারণ মানুষের সমর্থন মিলবে। এসব প্রশ্ন এখন তাদের সামনে। ফল হিসেবে যা দাঁড়াতে পারে তা হলো: বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ভয় উভয়পক্ষের নেতাদের। ভেস্তে যেতে পারে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য। বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ভাঙ্গনের সুর এখন স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত এই ঐক্য মাঠ পর্যায়ে কতটুকু স্থায়ী হবে তাই এখন দেখার বিষয়। তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। মামলার রায় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না, একথা বলছেন দলটির নেতারা। আবার ঐক্য প্রক্রিয়ার একাধিক নেতা রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, একুশ আগস্ট বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের কারণে বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনে সমস্যা হবে না। গত দুই দিনে অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা মীর্জা ফখরুল ও ব্যারিস্টার মওদুদ। জাতীয় ঐক্যের নেতারা বলছেন, একটি দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ওই হামলা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়েই তারা আন্দোলন করবে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সাজা প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া বলছে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কোন্ দল কী ভূমিকা রাখবে সেটা সে দলের নিজস্ব বিষয়। তাদের প্রত্যাশা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনার বাংলাদেশে আর কোন পুনরাবৃত্তি হবে না। জানতে চাইলে ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেন, একটি দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে এ ধরনের হামলা নিন্দনীয়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসিকতা দুঃখজনক। তবে, তিনি বলেন, মামলার রায়ে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার তেমন কোন সমস্যা হবে না। রায়ের বিষয়টি আলাদা। এর দায় যদি বিএনপির হয়ে থাকে তাহলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে তা মোকাবেলা করবে। রায়ের কারণে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না এমন মন্তব্য করে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঐক্যের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সমগ্র জাতি আজ ঐক্যের প্রশ্নে এক। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার রায় নিয়ে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখছি না। মামলার রায়ের ইস্যু তুলে বৃহত্তর ঐক্য ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া যাবে বলে মনে হয় না। বুধবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে দণ্ডিতদের মধ্যে সাতজন সরাসরি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিণ্টু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। হানিফ পরিবহনের মালিক মোঃ হানিফও বিএনপির নেতা। আবার তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ কাজী মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ ও ঢাকা মহানগর নেতা আরিফুল ইসলামকে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন। বিএনপি সরকারের আমলে ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রধানদেরও মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। কারাদণ্ডের সাজা পেয়েছেন বিএনপি আমলের তিন আইজিপিও। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই হামলা করেছে। অর্থাৎ এ দায় সরাসরি বিএনপি সরকারের ওপর গিয়ে পড়েছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে রায় হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে বিএনপির তথা তখনকার সরকারের অনুগত। রায়ের পরদিনই বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ঐক্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সস্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, কোন্ নৈতিকতায় এই ঐক্য করা যায়। খুনীদের সঙ্গে কোনদিন জাতীয় ঐক্য হতে পারে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই প্রশ্ন রেখে কাদের বলেন, দেশের একজন বিবেকবান মানুষও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে ফরমায়েশি বলে মানবেন না। বিএনপি রাজনৈতিক অপরাধীদের অপরাধ আড়াল করতে আদালতের রায়কে ফরমায়েশি বলছে। বিএনপিকে ‘খুনী’ আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে ঐক্যের উদ্যোগ নেয়ায় গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীরও সমালোচনা করেন কাদের। বলেন, খুনীদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্য করবেন, এই জাতীয় ঐক্যে জনগণ কোনদিন বিশ্বাস করবে না, সমর্থন করবে না। একুশ আগস্টের খুনীরা, ‘মাস্টারমাইন্ড’(তারেক রহমান) যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। তিনি যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন সেই দলের সঙ্গে কোন্ নৈতিকতায় ঐক্য করেন? এই খুনী দলের সঙ্গে ড. কামাল, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরীÑ আপনারা তথাকথিত জাতীয় ঐক্য করছেন? বাংলাদেশের রাজনীতি কি খুনী, দ-িত আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের হাতে ন্যস্ত হবে- ড. কামাল ও বি. চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস এই জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশের জনগণ কোনদিন গ্রহণ করবে না। এ ধরনের জাতীয় ঐক্য যারা করে তারা কতটা নীতি-নৈতিকতাহীন দেউলিয়া রাজনৈতিক দল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও। তিনি বলেন, বিএনপি বড় দল হলেও সঙ্কট মুহূর্তে তারা কোন নেতা খুঁজে পাচ্ছেন না। আগে শুনেছি জমি ও গরু বর্গা দেয়া হয় এখন দেখছি দল বর্গা দেয়ার জন্য ড.কামাল ও বি. চৌধুরীর কাছে ধর্ণা দিচ্ছে বিএনপি। যে বি. চৌধুরী আমাদের সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, বলেছে- বিএনপির কোন বেল নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাকেই এখন শক্তি মনে করছেন। জাতীয় ঐক্য প্রসঙ্গে ১৪ দলের অন্যতম শরিক নেতা মেনন বলেন, জাতীয় ঐক্যের নামে দেশে শয়তানে শয়তানে জোট হচ্ছে। এদেশে শয়তানদের রাজত্ব কায়েম করতে দেয়া হবে না। সব মিলিয়ে ইতিহাসের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে অস্বস্তি বিরাজ করছে বিএনপিজুড়ে। মুখে ‘ফরমায়েশি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় বললেও দলটির নেতাকর্মীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা স্পষ্ট। শুধু বিএনপি নয়, দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও নতুন রাজনৈতিক মিত্রদের মধ্যেও রায়ের পর ‘মুখ লুকানো ভাব’ পরিলক্ষিত হচ্ছে। একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিকল্পধারা সভাপতি ও যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি বলেছেন, এই রায় চূড়ান্ত নয়। এটা রায়ের প্রথম ধাপ। এরপর আইনী প্রক্রিয়ার আরও ধাপ অবশিষ্ট আছে। চূড়ান্ত রায়ের পর সবকিছু পরিষ্কার হবে। বিএনপি চায় ১৮ অক্টোবরের পর ঐক্য প্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসে খালেদা জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি ও তফসিলের আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করবে। তবে এতে আপত্তি জানিয়েছে বৃহত্তর ঐক্যের অন্যতম অংশীদার যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট প্রধান অধ্যাপক বি. চৌধুরী ও তার পুত্র মাহী বি. চৌধুরীসহ ফ্রন্টনেতারা চান ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আলোচনায় যাওয়ার আগে আগামীতে রাজনীতিতে ও সরকার গঠনে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনে আসন বণ্টনের ফয়সালা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তাফা আমীন জানান, স্থগিত বৈঠকটি শুক্রবার আবার বসছে।
×