ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাহমুদ কামাল

নানামাত্রিক হাসান হাফিজ

প্রকাশিত: ০৮:০০, ১২ অক্টোবর ২০১৮

নানামাত্রিক হাসান হাফিজ

উত্তাল সময়ের শুরু থেকেই কবি হাসান হাফিজ কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন, পাশাপাশি স্বাধীনতা পরবর্তী হতাশায় নিমজ্জিত সময়কেও তিনি ধারণ করেছেন। মুক্তির দশকের এক অগ্রগণ্য কবি হাসান হাফিজ। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন। বোধকরি সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে তার কাব্য সংখ্যা সর্বাধিক। হাসান হাফিজের একটি বড় গুণ তিনি অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও কবিতা লিখতে পারেন। সেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়টি কবিতা হয়ে ওঠে অনায়াসে। কবির শক্তিমত্তা এখানেই। আবার এক পঙ্ক্তির কিছু কবিতা লিখেছেন, ‘প্রতিটিই এক পঙ্ক্তি’ শিরোনামে। সেই কবিতাগুচ্ছের ৩৪টি পঙ্ক্তিই অসাধারণ। কয়েকটির বিষয় অতি সাধারণ কিন্তু কাব্য বিচারে তা অসাধারণ। প্রতিটি পঙ্ক্তি অর্থদ্যোতনায় পূর্ণাঙ্গ কবিতা হয়ে উঠেছে। এখানে সাতটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করি- ১. যে চাঁদে কলঙ্ক নেই আলো তার নিষ্কলঙ্ক হতেই পারে না ৩. যে পোড়ে, সে অন্যকেও শিল্পিত সূক্ষ্মতাসহ পোড়াতে সক্ষম ৪. ভালবাসা তোমার গোপনে জ্বলে কতটুকু অন্ধকার ও আলো ১১. যে নিজে বন্ধন চায়, মুক্তির মাহাত্ম্য বল কে তাকে বোঝাবে ১২. তুমি যদি কঠিন শব্দও হতে, অভিধানে অর্থ পাওয়া যেত! ১৪. তোমার নৈকট্যে গেলে মনে হয় দূরত্বই তার চেয়ে ভাল ২৯. তোমার আকাক্সক্ষা-বীজে আমিই তো শীতনিদ্রা, কিছু টের পাও? ( কবিতাসমগ্র ২; পৃষ্ঠা: ১৮ ) উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিগুলো একেকটি কবিতা এবং তা পূর্ণাঙ্গই। কবি প্রতিটি পঙ্ক্তিকে টেনে লম্বা করতে পারতেন। বোধকরি তাতে চর্বিত চর্বণ ছাড়া নতুন কিছু হতো না। হাসান হাফিজের বৃহৎ কাব্যসংসারে এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি কলম ধরেননি। শুরুতেই বলা হয়েছে তুচ্ছ বিষয়ের কথা। এবার জীবনের নানা দিকের মধ্যে একটি পর্যায়ে আসি, যা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। না পাওয়ার বেদনা তো আছেইÑ পাবারও বেদনা আছে। প্রতিটি কবির প্রধান শর্ত শব্দের আরাধনা। সে স্তুতিই হোক কিংবা স্তবই হোক। কবি যখন বলেন, ‘একটি শব্দকে আমি ভালবেসে নিঃস্ব হতে হতে/এ পর্যন্ত পর্যটন সম্পন্ন করেছি।’Ñ তখন মনে হয় এ অনুধাবন প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ‘স্তুতি ও স্তবের ভিত’ কবিতায় কবির যে পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে, সেটি আবহমানকাল থেকেই নিরবধি বয়ে চলেছে। তবে অর্থদ্যোতনায় হাসান হাফিজের এই কবিতাটি ভিন্ন মাত্রার। নদীর স্রোত কিংবা জোয়ারকে তিনি এভাবে অর্থময় করেছেনÑ ‘জোয়ারের খিলখিল ফোটা।’ এ এক নতুন আবেগ, নতুন পর্যবেক্ষণ। হাসান হাফিজের অসংখ্য ভাল কবিতার মধ্যে ‘স্তুতি ও স্তবের ভিত’ একটি অন্যতম কবিতা। স্তুতি ও স্তবের পরিপূরক আরও একটি কবিতা, ‘দুর্ধর্ষ তিয়াসা।’ তৃষ্ণার নানা দিক উঠে এসেছে কবিতাটিতে। শুরু করেছেন এভাবেÑ ‘তৃষ্ণা কি ঘুঙুর?’Ñ এরপর ‘তৃষ্ণা কি জোনাকি?’ আবার, ‘তৃষ্ণা কি ডাকাত?’ তৃষ্ণার এবং তৃষিতের চাওয়া পাওয়ার কোন সীমা পরিসীমা নেই। কবির ভাষায়, ‘দ্রবীভূত পরমাণু গড়ে তোলে আচ্ছন্ন লিরিক।‘ তৃষ্ণা সে রকমই এক লিরিক, আকণ্ঠ ভরপুর হলেও তবুও থাকে অনন্ত তিয়াসা। কবির উক্তি, ‘ রক্তারক্তি ছাড়া কোন মোক্ষ নেই নিষ্কৃৃতি নেই। নদী নিয়ে কবিতা লেখেননি, বাংলা সাহিত্যে এমন কোন কবি নেই। নদী নিয়ে হাসান হাফিজের বেশ কিছু কবিতা আছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর কি অবস্থা, তা সবাই কম বেশি জানেন। এ নিয়ে বিশদ বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন এখানে নেই। আমরা হাসান হাফিজের ‘উজ্জ্বল নতুন মাত্রা’ কবিতার প্রথম পাঁচটি পঙ্ক্তি পাঠ করেই বুঝে নেব নদীর হালহকিকত। ‘নদী, তুমি কতটুকু নদী? Ñযতক্ষণ আমার হৃদয়ে জল অনন্ত প্রবাহ, চোখমুখ ঢেকে দিলে পলি ও পাথর আমার অস্তিত্বে চড়া বালিয়াড়ি, আমি আর নদী নই, মৃত এক চিত্রকল্প ধূসর খোঁয়ারি’ ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে কবিতা অনেকেই লিখে থাকেন। কবির দায়বোধ থেকে উৎসারিত এ জাতীয় কবিতার আলাদা একটা মূল্য রয়েছে। পাশাপাশি নির্জলা আবেগের বহিঃপ্রকাশও ঘটতে দেখা যায় এ ধরনের অনেক কবিতায়। এসব বিষয়ের কবিতা তখনই ডানা মেলে, যখন পরোক্ষ অর্থটি প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে শব্দের অপূর্ব রসায়নে। তেমনি একটি কবিতা, ‘সন্তোষে।’ ছোট এই কবিতায় কোথাও মওলানা ভাসানীর নাম নেই, কিন্তু পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না মজলুম জননেতা প্রত্যক্ষ হয়েছেন কবির কাব্যকুশলতার কারণেই। পুরো কবিতাটি এখানে তুলে আনি- “সেই গাছপালা, ম্লান জমিদার বাড়ি পুকুরের নির্বিরোধ জল নীল মেঘে থই থই অনন্ত আকাশ মেঠো মানুষের ভিড়, সান্দ্র কোলাহল নৌকাভরা ধোঁয়াচ্ছন্ন গরম খিচুড়ি সারবন্দী দলিত মজদুর এলেমেলো ছেঁড়াখোঁড়া উন্নত ও ঋজু সনাতন চোখমুখে দ্বিধাহীন দ্যুতি প্রকৃতির পাঠশালা টিকে আছে একমাত্র শুধু নেই তাদের হৃদয়।” ( সন্তোষে : কাব্যসমগ্রÑ ১; পৃষ্ঠা ১১১ ) হাসান হাফিজ ছন্দ সচেতন কবি। তিনি দারুণ ছড়াও লিখে থাকেন। বাংলা কবিতা থেকে ছন্দ এখন প্রায় নির্বাসিত। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কবি ছন্দবিমুখ। নির্মম সত্য হলো, তাদের অনেকে ছন্দ না জেনেই কবিতা লিখে চলেছেন। আবার ছন্দকে ভেঙে অনেকেই করেছেন নতুন নির্মিতি। ছন্দের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। হাসান হাফিজ ছন্দের সপক্ষের কবি। অক্ষরবৃত্ত যেমন তার হাতে প্রাণ পেয়েছে, মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্তেও তিনি অবাধে বিচরণ করেছেন। এখানে মাত্রবৃত্ত ছন্দের একটি কবিতার ১০টি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করি- তোমাদের পারস্য গালিচা আমাদের ছেঁড়াখোঁড়া কাঁথা তোমাদের হাইহিল জুতো আমাদের কর্দমাক্ত পা তোমাদের ককটেল-ফেনা আমাদের গোধূলি-গোপাট তোমাদের ফ্রিজের মাখন আমাদের কচু ঘেচু রুটি তোমাদের নীলছবি ক্রেজ আমাদের হার্দ্য ভাটিয়ালি ( তোমরা ও আমরা : কবিতাসমগ্র ১; পৃষ্ঠা ৮৯ ) একজন কবির সারাজীবনের শ্রমের ফসল থেকে যদি একটি বা দুটো পঙ্ক্তি দিক থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে, বিবেচনা করি, তাহলেই তিনি সার্থক কবি। কবির ভিড়ে না-হওয়া কবিতার কোলাহলে একটি সার্থক পঙ্ক্তি রচনা কম কথা নয়। সে রকম দুটো পঙ্ক্তি রচনা করে ফেলেছেন হাসান হাফিজ। ‘যেতে হবে, প্রকৃতি পাবে না টের, এমনই নীরবে।’ নিরাভরণ উপর্যুক্ত দুই পঙ্ক্তি আমাদের উৎসমূলে ফিরে যাবার এক কঠিন ইঙ্গিত।
×