ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

-এ এন রাশেদা

সমতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা জরুরী

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১২ অক্টোবর ২০১৮

সমতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা জরুরী

সমাজ ব্যবস্থার শাসন-শোষণ আর বৈষম্যকে পাশ কাটিয়ে পবিত্র শিক্ষা কার্যক্রম শুধু সব মানুষের নাগরিক অধিকারই নয় সার্বজনীনভাবে প্রত্যেকে তাতে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতাও বটে। এই অতি প্রয়োজনীয় বার্তাটিকে সামনে রেখে এ এন রাশেদা এই মহৎ কর্মযোগের যে পথযাত্রা শুরু করলেন আজও সেখানে নিবেদিত হয়ে এই সাময়িকীর কলেবর বৃদ্ধি করে চলেছেন। প্রচলিত সামাজিক অবয়ব যে কোন ব্যক্তিকে তৈরি করে সচেতনতায় ঋদ্ধ হয়ে কোন এক আদর্শিক বোধে নিজেকে সমর্পণ করতেন। রাশেদা আপাও সেই মানবিক আর মানসিক চৈতন্যে অতি বাল্যকাল থেকে নিজের গন্তব্য স্থির করেন। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া এই শিক্ষাবিদ তার শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করেন তৎকালীন মফস্বল শহর রংপুরে। পিতা মোঃ আজহার আর মাতা আয়েশা খাতুনের ৮ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। ১৯৬৬ সালে রংপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৮ সালে রংপুর মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় চলে আসেন। স্মৃতির মিনারে এখনও ভাবে শিক্ষার প্রতি এক অনমনীয় বোধে কিভাবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কর্মসূচীতে তাড়িত হয়েছিলেন। তখন তিনি মাত্র ১২ বছরের বালিকা। পড়ছেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ১৯৬৮ সালেই ঢাকা ইডেন গার্লস কলেছে ভর্তি এবং সফলতায় উত্তীর্ণও হন। ছোট বয়স থেকে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী রাশেদা প্রতিটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে তার মেধা ও মননের ছাপ রাখেন। তার ওপর ছিল আবৃত্তি করার তীব্র বাসনা। নিজে তো কবিতার বই পড়তেন সঙ্গে সঙ্গে বিখ্যাত আবৃত্তি শিল্পীর বাচনভঙ্গি, শব্দ উচ্চারণ, কাব্যিক আবহকে নিজের মতো ধারণ করার চেষ্টাও করতেন। কৃতী ছাত্রী ও আবৃত্তিকার হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন অনেক বই। সে সব তার কাছে এক মহামূল্যবান সম্পদ ছিল। বড় ভাই ছিলেন বাম রাজনীতির এক দৃঢ় সমর্থক। সে সময়ের ন্যাপ ওয়ালি খানের সংগঠনভুক্ত ভাসানী ন্যাপের অনুসারী ছিলেন। সেই বাম আদর্শিক চেতনা রাশেদা আপার মধ্যে অনুরণিত হতে সময় নেয়নি। ১৯৭০ সালে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’কে বিশেষভাবে মনে করতে না পারলেও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যখন সারা বাংলাকে কাঁপিয়ে দেয় সেই সাড়া জাগানো আন্দোলনে নিজের অংশীদারিত্ব আজও স্মরণীয়। কলেজ থেকে ছাত্রীদের নিয়ে মিছিলে অংশ নেয়ার সেই অভাবনীয় অনুভূতি জীবনে ভুলে যাওয়ার নয়। পর পরই চলে আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া এ এন রাশেদা এখনও সেই দীপ্ত চেতনায় নিজেকে শাণিত করেন। পরের ইতিহাস জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলীর এক অবিস্মরণীয় দলিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয় মাসের রক্তাক্ত অভিযাত্রা এখনও নানামাত্রিকে উজ্জীবিত করে। স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুদের নবোত্থানে শুধু বিস্মিতই হন না একা অদম্য তাড়নায় মনন আর বিবেক নতুনভাবে জেগেও ওঠে। ’৭৫-এর রক্তাক্ত প্লাবন যেভাবে সারা জাতিকে শিহরিত করে সে বেদনায় তিনিও মুহ্যমান ছিলেন। ঠিক তার আগের বছর ১৯৭৪ সালে আর এক গুণীজন ড. গোলাম মহিউদ্দিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। বুয়েট থেকে পাস করা মেকানিক্যাল প্রকৌশলী প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। ১৯৮৭ সালে সংযুক্ত হলেন বুয়েটে শিক্ষক হিসেবে। ইতোমধ্যে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে রাশেদা আপার স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জিত হয়। স্বামী, সন্তান এবং সংসারের ব্যস্ততম জীবনে, তখন পর্যন্ত কোন ধরনের পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে পারেননি। পারিবারিক জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসলে ১৯৮১ সালে যোগ দেন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। যে কলেজটি আজও ছাত্রদের ঐতিহ্যিক পথযাত্রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে নটর ডেম কলেজের ছাত্ররা এখনও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবীদের সিংহভাগ আসন দখল করে নেয়। অর্থাৎ অনেক কৃতী ছাত্রের শিক্ষক হিসেবে কিভাবে নিজেকে মূল্যায়ন করেন। স্মিতহাস্যে উত্তর আসেÑ শুধুই আনন্দ আর তৃপ্তি। আর কিছু কখনও আশাও করেননি। বিশেষভাবে কথা হলো ‘শিক্ষা বার্তা’ নিয়ে। এই শিক্ষাবিষয়ক সাময়িকীটি বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক অবয়ব তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশের খ্যাতিমান গুণীজনরা এই বিশেষ সাময়িকীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে শিক্ষা সম্পর্কিত নিজেদের সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। শিক্ষা জাতির মেরুদ-। এই অমোঘ বার্তাকে সামনে রেখে এই বিশিষ্ট অঙ্গনটিকে সর্বসাধারণের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয় শুরু থেকেই। সঙ্গত কারণে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের অধ্যাপক, গবেষক এবং বিশেষজ্ঞের লেখায়, পরামর্শে ‘শিক্ষা বার্তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন লেখা এবং বক্তৃতা ও সাময়িকীটির কলেবর পূর্ণতায় নিয়ে গেছে ড. আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দীন, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ড. কবির চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রঙ্গলাল সেন, ড. অনুপম সেন, সনৎ কুমার সাহা, হাসান আজিজুল হকসহ বাংলাদেশের অনেক জ্ঞানতাপস এই মহৎ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সব সময় ছিলেনÑ এখনও আছেন। আর রাশেদা আপাও সম্পাদকীয় পদ অলঙ্কৃত করে সমস্ত দায়-দায়িত্ব বহন করে চলেছেন। তাঁর নিজের বাসা ‘স্মরণ’ ভবনের নিচতলার এই ‘শিক্ষা বার্তা’র অফিস। লোকবল আর অর্থায়নের হরেক রকম সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সাময়িকী নিয়মিত প্রকাশ করার নিরন্তন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শুধু সম্পাদকই নন শিক্ষা বার্তার প্রকাশকও তিনি নিজেই। শিক্ষা সম্পর্কিত অনেক মূল্যবান তথ্যও তার মাধ্যমে জনসমক্ষে আসে। শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার যে সম্প্রসারিত পথচলা সেখানে তার প্রাসঙ্গিক আলোচনা-পর্যালোচনা এই বিশেষ অঙ্গনকে নানাভাবে পথনির্দেশনা করে থাকে। স্বামী মারা যান ২০০৪ সালে। ২ সন্তানের জননী বড় ছেলে, বউ ও তিন নাতি-নাতনি নিয়ে ‘স্মরণ’ ভবনে থাকেন। ছোট ছেলে আর বউ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। শিক্ষা বার্তার প্রয়োজনীয় পর্বগুলো সযতœ পরিচালনার বিদগ্ধ জনের মহাসমাবেশে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। যেমন, ২০০৭ সালে প্রকাশ করেন ২০ বছর পূর্তি আর ২০১২ সালে বের হয় ২৫ বছর উপলক্ষে পার হওয়া বছরের সম্পাদকীয় কলাম। যাতে নির্ধারিত বছরগুলোর সম্পাদকীয় পাঠকের সামনে হাজির করানো যায়। মাঝখানে তিন বছর (১৯১২-১৫) শিক্ষা বার্তার প্রকাশ বন্ধ ছিল। ২০১৮ সালে চেষ্টা করছেন ২৮ বছরের শিক্ষা বার্তার মূল অবয়ব পাঠককে উপহার দিতে। ৬৯ বছরের পা রাখা এ এন রাশেদা শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে দৃঢ়চেতা এক নারী ব্যক্তিত্ব। হাঁটুর ব্যথা সমস্যা তৈরি করলেও সেটাকে কাটাতে তার সময় লাগে না। ফলে বীরদর্পে সাবলীলচিত্তে শেষ অবধি ‘শিক্ষা বার্তা’র হাল ধরে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন এই অনন্য নারী। ফ্রি কিকের মধ্য দিয়ে ডিফেন্ডার মাসুরা পারভিনের অসামান্য পারদর্শিতায়। নেপালী নারী ফুটবলাররাও তাদের আধিপত্য বিস্তারে বিন্দুমাত্র নমনীয় ছিল না। হিমালয় পর্বতের পাদদেশে গড়ে ওঠা এই শক্ত ধাঁচের নেপালী নারীরা তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করলে শেষ অবধি নদীমাতৃক উর্বর পলিমাটির স্নিগ্ধ আবহে তৈরি হওয়া আমাদের মেয়েরা সর্বশেষ শৌর্য প্রয়োগ করে জয়ের মুকুট দখল করে নেয়। আন্তরিক অভিনন্দন বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের। আবারও প্রমাণ করল কোন খেলাই পুরুষের একচেটিয়া অধিকার নয়। কঠিন পিচ, ভারি বল কোনটাকে আজ তোয়াক্কা করে না রমণীয়, কমনীয় চিরায়ত বাঙালী মেয়েরা। ক্রিকেট আর ফুটবলের মতো কঠিন খেলাকেও আজ তারা জয় করেছে। অদম্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে নারীরাও সবক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করছে। সমৃদ্ধির স্বর্ণ দুয়ারে বাংলাদেশ। সেখানে দৃপ্ত অভিযাত্রায় অর্ধাংশ এই গোষ্ঠী স্পর্শ কিংবা অনুপ্রবেশে ব্যর্থ হলে দেশের সার্বিক অগ্রগামিতা দৃশ্যমান হবে না। প্রত্যেক নাগরিকের সম্মিলিত সহযোগিতা, অংশীদারিত্বই শুধু নয় পারদর্শিতার কৃতিত্ব অর্জনও সমস্ত উন্নয়ন সূচকে একান্ত আবশ্যক। সেই লক্ষ্যে অসম সাহসে বাংলাদেশ নিরন্তর সামনের দিকে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউই থেমে থাকছে না। নারী, পুরুষ সব শ্রেণীর মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে নিজের দায়িত্বটুকু যথার্থভাবে পালন করতে পারলে উন্নত বিশ্বকে ধরা কোন ব্যাপারই নয়। আমরা সেই পথেই নিজেদের গন্তব্য স্থির করেছি। না হলে ভাবা যায় কোমলমতি উদীয়মান তরুণীরা ফুটবলের মতো একটি দুরন্ত খেলায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পিছপা হয় না। খেলার ছলে ফুটবলের মতো দামী ঐতিহ্য নিয়ে নমনীয় মেয়েরা ছেলেমানুষিও করে না। বরং ঐতিহ্যিক এই খেলাকে যথার্থ মূল্য দিয়ে নিজেদের মনন, মেধা, শক্তিমত্তাই শুধু নয় সাহস আর দাপট প্রদর্শন করতেও দ্বিধা করে না। ভারি বলকে শক্ত মাটিতে গড়িয়ে যেভাবে বল তাক করার নৈপুণ্য প্রদর্শন করে সেখানে কোনভাবেই মনে আসে না নারীরা শারীরিকভাবে পুরুষের চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নরম। উন্নয়নের বিভিন্ন খাতে নারীদের এই অনন্য অগ্রগামিতা দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক শক্তি। যে অমিত তেজ আর দুর্দমনীয় মনোবলে নারীরা আজ ঘর থেকে বাইরে পা রেখেছে। ফুটবলের মতো এক কঠিন খেলাকে নিজেদের আয়ত্তেই আনেনি বিদেশের মাটিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্বে সারাদেশকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্তও করেছে। এই অপরাজেয় শক্তির মহিমা যেমন নারী ফুটবলারদের পাশাপাশি সারাদেশও এই বিজয় নিশানের পতাকা সম্মিলিতভাবে উপভোগ করছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সারাদেশ আনন্দের সাগরে ভাসছে। এই অপরাজিত দলকে শেখ হাসিনা অভিনন্দন জানিয়ে তাদের কাছ থেকে আরও সাফল্য প্রত্যাশা করেন। ফুটবলের ইতিহাসের এই গৌরবকে আরও বাড়ানোর উৎসাহ দেন।
×