ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কিয়ামুল লায়ল- তাহাজ্জুদ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১২ অক্টোবর ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কিয়ামুল লায়ল- তাহাজ্জুদ

কিয়ামুল লায়ল অর্থ হচ্ছে রাতে দাঁড়ানো বা রাত জেগে ইবাদত করা। কিয়ামুল লায়ল স্বেচ্ছামূলক বা নফল। এর মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে তাহাজ্জুদ। তাহাজ্জুদ শব্দের সামগ্রিক অর্থ হচ্ছে রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে সালাত আদায় করা। সালাতের ফারসী অর্থ করা হয়েছে নামাজ। ফারসী এই নামাজ শব্দটি সালাত অর্থে আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ জন্যই তাহাজ্জুদ সালাতকে আমরা তাহাজ্জুদের নামাজ বলি। তবে সালাত বলাটাই উত্তম। কুরআন মজিদে তাহাজ্জুদ সালাতের উল্লেখ আছে। ইরশাদ হয়েছে : ওয়া মিনাল লায়লি ফাতাহাজ্জাদ বিহী নাফিলাতাল্লাকÑ এবং রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ কায়েম করবে। (সূরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৭৯)। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৬১০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসের অধিকাংশের মতে রমাদানের ২৭ তারিখ রাতে প্রথম ওহী লাভের পূর্বে বেশ কয়েক বছর থেকে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম হেরা গুহায় গভীর মুরাকাবার মধ্যে বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করতেন। প্রথম ওহী নাযিলের প্রায় তিন বছর পর নিয়মিত ওহী নাযিল হওয়া শুরু হয়। তখন প্রথমে যে সূরা নাযিল হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সূরা মুয্্যাম্মিল, সূরা মদ্্দাসসির। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ওহী নাযিল হলে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় গৃহে ফিরে হযরত খাদিজাতুল কুব্্রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহাকে বলেছিলেন : যাম্মিলুনীÑ আমাকে বস্ত্রাবৃত কর বা আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও। তাই লক্ষ্য করা যায় সূরা মুয্্যাম্মিলে প্রিয় নবীকে (সা.) হে বস্ত্রাবৃত সম্বোধন করে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : কুমিল লায়লা ইল্লা কালীলা-নিস্্ফাহু আওভিনকুস মিনহু কালীলা-আওযিদ ‘আলায়হি- রাত্রি জাগরণ করুন, কিছু অংশ ব্যতীত, অর্ধরাত কিংবা তার চেয়ে অল্প অথবা তার চেয়ে বেশি। (সূরা মুয্্যাম্মিল : আয়াত ২-৪)। এই সূরায় তাহাজ্জুদের নির্দেশ লক্ষ্য করা যায়। এই সূরারই শেষে অর্থাৎ ২০ নম্বর আয়াতে কারিমায় সালাতের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়া আকীমুস্্ সালাত- আর সালাত কায়েম করুন। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম মিরাজ সফর থেকে ফেরার সময় আল্লাহ্্র কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের হুকুম নিয়ে আসেন। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের পূর্বে তাহাজ্জুদ সালাত প্রিয় নবী (সা) এবং তাঁকে অনুসরণ করে সাহাবায়ে কিরাম আদায় করতেন। সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : আপনার রব্্ তো জানেন যে, আপনি জাগেন কখনও রাতে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, কখনও রাতের অর্ধাংশ এবং কখনও এক-তৃতীয়াংশ এবং জাগে আপনার সঙ্গে যারা আছে তাদের একটি দলও। (সূরা মুয্্যাম্মিল : আয়াত ২০)। সূরা ফুরকানের ৬৪ নম্বর আয়াতে কারিমায় ইরশাদ হয়েছে : আর তারা রাত কাটায় তাদের রবের উদ্দেশ্যে সিজ্্দাবনত হয়ে এবং দ-ায়মান থেকে। তাহাজ্জুদের সালাত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের জন্য ফরজ ছিল, কিন্তু তাঁর উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অর্থাৎ ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব, এশার সালাত ফরয। তবে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করলে অশেষ সওয়াব লাভ করা যায় এবং আত্মিক, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয়; যে কারণে ইল্মে তাসাওউফে এই সালাতকে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হক্কানী সুফী ও আমিলগণ একে সুন্নতে মুআক্কাদা মনে করেন। রাতের দ্বিতীয়ার্ধে ঘুম থেকে জেগে ওযু করে (গোসলের প্রয়োজন থাকলে গোসল ও ওযু করে) দুই দুই রাক’আত করে সর্বোচ্চ বারো রাকা’আত আদায় করতে হয়। কমপক্ষে চার রাক’আত আদায় করলেও হবে, এমনকি দুই রাক’আত পড়লেও তাহাজ্জুদ আদায় হয়ে যাবে, বারো রাক’আত আদায় করাটাই ভাল। বারো রাক’আত আদায় করার ক্ষেত্রে সাধারণত সুফীগণ এই নিয়মে এই সালাত আদায় করেন। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস এগারো বারÑ এমনিভাবে প্রতি রাক’আতে সূরা ইখলাস এক একবার করে কমাতে কমাতে শেষ রাক’আতে একবার তিলাওয়াত করতে হয়। কুরআন মজিদ যত পড়া যায় তত সওয়াব। হযরত আবদুল্লাহ্্ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত আছে, হযরত রসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য জেগে উঠে এই দোয়া পাঠ করতেন : আল্লাহুম্মা লাকাল হাম্্দু আন্তা কাইয়ূমুস সামাওয়াতি ওয়াল র্আদি ফী হিন্না ওয়া লাকাল হাম্্দু, আন্তা নূরুস্্ সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়া মান্্ ফী হিন্না ওয়া লাকাল হামদুন, আনতা মালিকুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফি হিন্না ওয়া লাকাল হামদু আন্তাল হাক্কু, ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু ওয়া লিকাউকা হাক্কুন, ওয়া কাউলুকা হাক্কুন, ওয়াল জান্নাতু হাক্কুন, ওয়ান্্ নারু হাক্কুন, ওয়া নাবীয়্যূনা হাক্কুন, ওয়া মুহাম্মাদুন হাক্কুন, ওয়াস্্সা’আতু হাক্কুন। আল্লাহুম্মা লাকা আস্লামতু ওয়া বিকা আমান্তু ওয়া ‘আলায়কা তাওয়াক্্কালতু ওয়া ইলায়কা আনাবতু ওয়া বিকা খাসাম্তু ওয়া ইলায়কা হাকামতু, ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়ামা আখখারতু ওয়ামা আস্্রারতু ওয়ামা আ’লানতু ওয়ামা আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নি, আন্তাল মুকাদ্দিমু, ওয়া আন্তাল মুআখ্খিরু লা ইলাহা ইল্লা আন্তা ওয়া লা ইলাহা গায়রুকা। Ñহে আল্লাহ্্! তাবত প্রশংসা আপনারই, আপনি আসমানসমূহে ও জমিনে এবং যা কিছু আছে এগুলোর ভেতরে সেগুলোর সংস্থাপক ও রক্ষক। তাবত প্রশংসা আপনারই, আপনিই আসমানসমূহে ও জমিনে এবং ওগুলোর ভেতরে যা কিছু আছে সে সবেরই নূর। তাবত প্রশংসা আপনারই, আপনি আসমানসমূহে ও জমিনে এবং এর ভেতরে যা কিছু আছে সে সবেরই একমাত্র মালিক, তাবত প্রশংসা আপনারই জন্য, আপনিই হক, আপনার ওয়াদা সত্য, আপনার সঙ্গে সাক্ষাত হবে সেটাও সত্য, আপনার উক্তি সত্য, জান্নাত সত্য, দোজখের আগুন সত্য, সব নবীই সত্য, মুহম্মদ সত্য, কিয়ামত সত্য। হে আল্লাহ্্! আত্মসমর্পণ করছি আপনারই কাছে। আপনারই ভরসা করছি, প্রত্যাবর্তন করছি আপনারই কাছে। আপনারই ভরসা করছি, প্রত্যাবর্তন করছি আপনারই দিকে, আপনার সাহায্য নিয়ে লড়ি এবং কামনা করি আপনারই ফয়সালা। অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন- আমার আগেকার গোনাসমূহ, পরের গোনাসমূহ, গুপ্ত গোনাহসমূহ, প্রকাশ্য গোনাসমূহ- যেসব গোনাহ সম্পর্কে আমার চেয়ে আপনিই বেশি অবহিত। আপনি কাউকে অগ্রগামী করেন আবার কাউকে পশ্চাৎপদ করেন। আপনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্্ নেই, আপনি ছাড়া কোন ইলাহ্্ নেই। (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)। প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য জেগে উঠে কখনও কখনও সূরা আল-ইমরানের শেষ দশখানা আয়াতে কারিমা পাঠ করতেন। হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘আলায়কুম বি কিয়ামিল লায়লি ফা ইন্নাহু দা বুস সলিহীন কাব্্লাকুম ওয়া ইন্না কিয়ামাল লায়লি র্ক্বুাতুন ইলাল্লাহি ওয়া মান্্হাতুন ‘আনিল ইছমি ওয়া মুকাফ্ফিরাতুন লিস সাইয়াতে ওয়া মুর্ত্ািরদাতুন লিদদায়ে ‘আনিল জাসাদ- তোমাদের ওপর কর্তব্য কিয়ামুল লায়ল (রাতে জেগে তাহাজ্জুদ সালাত আদায়) করা। কেননা এটা তোমাদের পূর্বেকার সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের অভ্যেস ছিল এবং নিশ্চয়ই অভ্যেস ছিল এবং নিশ্চয়ই কিয়ামুল লায়ল (তাহাজ্জুদ) আল্লাহর কুদ্্রত (নৈকট্য) লাভের পন্থা, অপরাধ-অশ্লীলতা-দোষ-ত্রুটি থেকে বিরত থাকার উপায়, গোনাহ্্সমূহ মোচনকারী এবং শরীরের রোগ দূরকারী। (তিরমিযী শরীফ)। এখানে লক্ষণীয়, শেষরাতে এই সালাতকে রোগ নিরাময়কারী বলা হয়েছে। একটা বর্ণনায় আছে, তিনটি জিনিসের মধ্যে রোগ নিরাময়ের ঔষধি রয়েছে আর তা হচ্ছে : মধু, কালোজিরা এবং তাহাজ্জুদ। একখানা হাদিসে আছে যে, তাহাজ্জুদ অন্তরকে প্রফুল্ল করে, পবিত্র মনের অধিকারী করে। তাহাজ্জুদ সালাতের নিয়ত দুই রাক’আত করে করতে হয়। হযরত আবদুল্লাহ্্ ইব্নে উমর (রাদি.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : সালাতুল লায়লি মাছুনা মাছনা- রাতের সালাত দুই দুই রাকা’আত করে। (বুখারী শরীফ)। তাহাজ্জুদ সালাতের নিয়ত এইরূপ : নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকা’আতাই সালাতিত্্ তাহাজ্জুদ সুন্নাতু রসূলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ্্ শারিফাতি আল্লাহু আকবার। অনেক সুফীই তাহাজ্জুদ সালাতকে নিজের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করে নিয়েছেন। রাতের দ্বিতীয় ভাগে যখন সর্বত্র নীরবতার এক অনন্য অনুভূতি, যখন সবাই ঘুমে অচেতন, তখন জাগ্রত হয়ে এই সালাত আদায় করার মধ্যে যে কি আনন্দ, সুখ, পবিত্রতার আমেজ লুকিয়ে আছে তা যাঁরা এই সালাত আদায় করেন তাঁরাই কেবল দৈহিক ও মানসিক উভয়ভাবে অনুধাবন করেন। তাহাজ্জুদ ফরজ কিংবা ওয়াজিব না হলেও, এটা ছাড়লে গোনাহ না হলেও এটা পড়লে অশেষ সওয়াবের উল্লেখ রয়েছে। নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায়কারী সর্বক্ষণ প্রফুল্লতার মধ্যে থাকেন, তাঁদের চেহারার একটা নূরের ঝলক প্রত্যক্ষ করা যায়। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবূ সাঈদ খুদ্্রী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত আছে, হযরত রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তিন ধরনের লোকের প্রতি নজর দিয়ে আল্লাহ সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা হচ্ছে, যারা রাতে দাঁড়ায় (তাহাজ্জুদ সালাত পড়ে), সালাতে যারা কাতার সোজা করে এবং যারা দুশমনের সঙ্গে লড়াইয়ে সারিবদ্ধভাবে দ-ায়মান হয়। (মিশকাত শরীফ)। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×