ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আক্ষেপের হারে সেমিতেই থামল বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১১ অক্টোবর ২০১৮

আক্ষেপের হারে সেমিতেই থামল বাংলাদেশ

রুমেল খান, কক্সবাজার থেকে ॥ ইরাকের রেফারি মোহাম্মেদ যাইদ থামের খেলা শেষের বাঁশি বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়লেন বাংলাদেশের কয়েকজন ফুটবলার। এদের মধ্যে আলাদা ছিলেন দু’জন। একজন তপু বর্মণ। মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বসা। আরেকজন বিশ্বনাথ ঘোষ। দু’হাতে লম্বা করে উপুড় হয়ে ঘাসের ওপর শোয়া। ফিলিস্তিনের দীর্ঘদেহী ডিফেন্ডার-অধিনায়ক আবদাল লতিফ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বিশ্বনাথকে ধরে ওঠালেন। কাঁদছেন বাংলাদেশের এই ডিফেন্ডার। লতিফ জড়িয়ে ধরলেন বিশ্বনাথকে। দিলেন সান্ত¡না। খেলা শেষ। কিন্তু কি আশ্চর্য। গ্যালারি ছেড়ে যাবার নাম নেই দর্শকদের। কোচ জেমি ডে পুরো দলকে নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করালেন। দর্শকরা হাততালি বাজিয়ে ভালবাসা জানালো লাল-সবুজবাহিনীকে। খেলা শেষ হবার বর্ণনাটা পড়ে পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন বুধবার বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় সেমিফাইনালে হেরে গেছে বাংলাদেশ। হ্যাঁ, সেটাই। স্বাগতিকদের ২-০ গোলে হারিয়ে (খেলার প্রথমার্ধে বিজয়ী দল এগিয়ে ছিল ১-০ গোলে)। ফাইনালে নাম লেখায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ফিলিস্তিন, যারা এই আসরের সবচেয়ে শক্তিশালী দল বলে আখ্যা পেয়েছে। ১০০ ফিফা র‌্যাঙ্কিংধারী ফিলিস্তিন আগামী ১২ অক্টোবর ফাইনালে মুখোমুখি হবে ১২০ র‌্যাঙ্কিংধারী মধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানের। খেলাটি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে আসরটি। আর প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই ফাইনালে পৌঁছে গেল ফিলিস্তিন। এই আসরে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সেমিফাইনাল খেললো বাংলাদেশ এবং সেমিফাইনাল খেলে বিদায় নিল দ্বিতীয়বারের মতো। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সেমির ম্যাচে বাহরাইন অনুর্ধ-২৩ জাতীয় দলের কাছে ০-১ গোলে হেরেছিল স্বাগতিক দল। বুধবার বিপুল দর্শক সমর্থন এবং অনুকূল আবহাওয়া (বৃষ্টির কারণে মাঠ ছিল ভেজা, কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল)... কোনটি দিয়েই হার এড়াতে পারলো না বাংলাদেশ দল। যদিও তারা চমৎকার গতিশীল-লড়াকু ফুটবল খেলেছে, কিন্তু সেটা যে যথেষ্ট ছিল না জেতার জন্য। এ নিয়ে চারবার মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ-ফিলিস্তিন। তিনবারই হারলো বাংলাদেশ। একটি ম্যাচ ড্র হয়। সত্যি বলতে কিÑ আসলে স্কোরলাইন কখনই বোঝাতে পারবে না বুধবারের সেমির ম্যাচে কতটা অসাধারণ-ভাল খেলেছিল বাংলাদেশ। আক্রমণ সামাল দিয়ে বিপজ্জনক পাল্টা আক্রমণ, প্রচুর গোলের সৃষ্টি করা, দৈহিক গড়ন-উচ্চতায় পিছিয়ে থেকেও সমানতালে গতিশীল খেলা, প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করা, দর্শকদের ভালবাসা পাওয়া... এ সবই করেছে জেমি ডে’র শিষ্যরা। এক কথায় বলতে গেলে এই ম্যাচে সবকিছুই করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল, শুধু গোলটাই আদায় করতে পারেনি। ভাল খেলেও আক্ষেপের হার... এমন ফুটবলের সঙ্গে দর্শকদের পরিচিতি নেই অনেকদিন ধরেই। অবশ্য বাংলাদেশের এতটা ভাল খেলার পেছনে যার সবচেয়ে বেশি অবদান সেটা হচ্ছে ভেজা-পিচ্ছিল মাঠ! আর এমন কন্ডিশনের কারণেই জেতার স্বপ্ন দেখেছিল স্বাগতিক দল। সেই স্বপ্ন বাস্তবে ফলাতেও পারতো তারা। কিন্তু পারেনি ডিফেন্ডারদের দুটি ভুলের কারণে। একবার ম্যাচ শুরুর দিকে, আরেকবার ম্যাচের শেষের দিকে। মাঝের সময়টুকু বলতে গেলে ‘বাঘের’ মতোই খেলেছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানেই প্রমাণ মিলবে। বল পজিশন (৫৫%-৪৫%), আক্রমণে (১২১-১১১), বিপজ্জনক আক্রমণে (৭৩-৬৪), কর্নারে (৬-৪) এবং অফ টার্গেটে (৯-৭) এগিয়ে ছিল জামালবাহিনীই। শুধু অন টার্গেটে (৮-৪) এবং গোল স্কোরিংয়েই পিছিয়ে ছিল। আর এটাই দু’দলের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দেয়। ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলা শুরু করা বাংলাদেশ দলের মধ্যমাঠ এবং আক্রমণভাগ বেশ ভাল খেললেও সমস্যা ছিল রক্ষণভাগে। তারা আরও বেশি গোল হজম করতে পারতো যদি না গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম রানা অসাধারণভাবে কমপক্ষে ৪টি নিশ্চিত গোল বাঁচাতেন। মিডফিল্ডার বিপলু আহমেদ মাঝে মধ্যেই চমৎকার ডজ দিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন। কিন্তু আসল যে কাজÑ গোল করা সেটাই করতে পারেননি নাবিব নেওয়াজ জীবন-মাহবুবুর রহমান সুফিল এবং তৌহিদুল আলম সবুজরা। বিশেষ করে জীবনের মিসগুলো ছিল বিস্ময়কর এবং চরম আক্ষেপের। দু’বার তিনি নিশ্চিত গোল পেতে পারতেন। কিন্তু প্রতিবারই পোস্টের বাইরের জালে শট মেরে সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন। এছাড়া বল ভেজা থাকায় বিশ্বনাথের লম্বা থ্রোগুলোর একটিও ভালমতো হয়নি। বাতাসে বল দখলের লড়াইয়ে খুব কমই জিততে পেরেছে বাংলাদেশ। একমাত্র লোকাল প্লেয়ার হিসেবে মাঠে নেমেছেন সবুজ, তাও বদলি হিসেবে। কিন্তু যতটুকু (১০ মিনিট) ছিলেন তেমন কিছুই করতে পারেননি। পক্ষান্তরে প্রতিপক্ষের সঙ্গে ফিলিস্তিনকে লড়তে হয়েছে কাদামাখা মাঠের সঙ্গেও। যদিও শারীরিক শক্তি, ফিটনেস এবং গতিতে তারাই ছিল এগিয়ে। কিন্তু কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে তাদের যথেষ্ট বেগ দেয় স্বাগতিক দল। ম্যাচের প্রথম ১০ মিনিট পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করে ফিলিস্তিন। ৮ মিনিটে গোল করে এগিয়ে যায় তারা। ডানপ্রান্ত দিয়ে মুসাব বাতাত ক্রস দেন মোহাম্মদ এমএম বালাহকে। দীর্ঘদেহী এ মিডফিল্ডার বক্সের ভেতরে লাফিয়ে উঠে হেড করে গোল করেন। বাংলাদেশের ডিফেন্ডাররা চেষ্টা করেও তাকে আটকাতে পারেননি। ইনজুরি সময়ে আরেকটি গোল খেয়ে বসে বাংলাদেশ। এবারও সেটা ডিফেন্সের ভুলে। দাবাগের হেডে একেবারে ফাঁকায় দাঁড়ানো বদলি সামেহ আরাবা বল পান। নিখুঁতভাবে ফিনিশ করেন তিনি। এর ফলে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের সমতায় ফেরার আশা। ফিলিপিন্স ম্যাচে দল নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন কোচ জেমি ডে। সেমিফাইনালে আর কোন পরীক্ষা করেননি। আগের ম্যাচে বিশ্রামে থাকা ওয়ালী ফয়সাল, অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া, বিশ্বনাথ ঘোষ এবং মাহবুবুর রহমান সুফিল ছিলেন শুরুর একাদশে। কক্সবাজারের চার ফুটবলার- মোহাম্মদ ইব্রাহিম, তৌহিদুল আলম সবুজ, আনিসুর রহমান জিকো এবং সুশান্ত ত্রিপুরা ছিলেন সাইড বেঞ্চে। শেষ পর্যন্ত রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে গোল মিসের আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ দল। ব্যর্থ হয়ে যায় কন্ডিশনকে কাজে না লাগাতে পারা কক্সবাজারের মাটিতে অভিষিক্ত জাতীয় দলের সব প্রচেষ্টা।
×