ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেনেড হামলা মামলার জবানবন্দী ॥ শেখ হাসিনার জবানবন্দী

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১১ অক্টোবর ২০১৮

গ্রেনেড হামলা মামলার জবানবন্দী ॥ শেখ হাসিনার জবানবন্দী

১৪ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দীন এই রায় দেন। এর রায়ের মধ্য দিয়ে নৃশংস-বর্বর এই হামলার বিচার বিচারিক আদালতে শেষ হলো। এ নিয়ে বিশেষ আয়োজন পড়ুন ৭ ও ৯-এর পাতায়। ২০০৭ সালের ২২ নবেম্বর কারাবন্দী অবস্থায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জবানবন্দী দেন। জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করেন সিআইডির তদানীন্তন সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল কবির। তার জবানবন্দী নিম্নে তুলে ধরা হলো- ‘আমার বয়স ৬১ বছর। আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। অদ্য ২২/১১/০৭ ইং তারিখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীন শেরেবাংলা নগরস্থ বিশেষ সাবজেলে আপনাকে, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ ফজলুল কবির জেনে এই জবানবন্দী প্রদান করছি যে, গত ২১ শে আগস্ট ২০০৪ ইং ব্রিটিশ হাই কমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা এবং গোপালগঞ্জে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মুক্তাঙ্গনে একটি প্রতিবাদ র‌্যালি করার জন্য কয়েকদিন পূর্বে অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের বরাবরে আবেদন করা হয়। কিন্তু ২০/০৮/০৪ ইং তারিখ সকাল পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মুক্তাঙ্গনে র‌্যালি করার অনুমতি প্রদান না করায় আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র সামনে র‌্যালি করার জন্য প্রস্তুতি নেই। পত্রপত্রিকাতে সেইভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২১ শে আগস্ট ২০০৪ ইং তারিখ বিকেল ১৬.৩০ মিনিটে (সাড়ে চারটা) আমি সুধাসদন হতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র র‌্যালির উদ্দেশে রওনা হই। আমার গাড়ি বহর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পৌঁছার পর আমি মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকে উঠি। ট্রাকে বক্তব্য রাখার সুবিধার্থে একটি কাঠের টেবিল ছিল। ট্রাকের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ কার্যালয় হতে আনুমানিক ১৫/২০ গজ পূর্বদিকে। ট্রাকটি পূর্বমুখী অবস্থায় ছিল। ট্রাকের পেছনের দিকে রক্ষিত কাঠের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব দক্ষিণ দিকে মুখ করে আমি কর্মী, সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখি। বিকেল ১৭.২২/২৩ ঘটিকার (৫টা ২২ বা ২৩ মিনিট) সময় আমার বক্তৃতা শেষ হয় এবং আমি ট্রাক থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম। এই সময় ফটো সাংবাদিক গোর্কি (এস এম গোর্কি) আমাকে বলে...‘আমি ছবি নিতে পারি নাই’, যখন আমি তাকে ছবি নেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য একটু থামি, ঠিক তখনই সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বিস্ফোরণের শব্দ হয়। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে আমরা যারা ট্রাকের ওপর ছিলাম, সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে, বসে পড়ি। এরই মধ্যে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণ একটু থামলে কর্মীরা আমাকে ট্রাক হতে নামিয়ে আমার বুলেট প্রুফ জিপ গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। আমি জিপের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আবারও বিস্ফোরণ শুরু হয়। আমাকে টেনে ট্রাকে রক্ষীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুনরায় মানববর্ম তৈরি করে নেতাকর্মীরা আমাকে রক্ষা করার জন্য তৎপর হয়। এরপরে এক পর্যায়ে আমাকে বুলেট প্রুফ জিপে তোলা হয়। সন্ধ্যা অনুমান ৬টার সময় আমি সুধাসদনে পৌঁছি। সভা মঞ্চের ট্রাকে আমি ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, শেখ সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরউল্লা, জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে জানতে পারি বিস্ফোরণগুলো ছিল গ্রেনেড বিস্ফোরণ। উক্ত গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ আমাদের দলের ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং শত শত নেতা, কর্মী, সমর্থক আহত হয়। অনেকে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের পরেও পঙ্গুত্ববরণ করে। এই ঘটনায় আমার শ্রবণশক্তি খোয়া যায়। বিদেশে চিকিৎসার পরও আমার ডান কানের শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক হয় নাই। এ ঘটনায় মৃত ২২ জন ছাড়াও আরও ২টি অশনাক্ত লাশ ছিল। সাধারণত এই ধরনের জনসভা বা র‌্যালি হলে সভা মঞ্চের আশপাশের দালানের ছাদে এবং বিভিন্ন ফ্লোরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারায় থাকে কিন্তু ২১শে আগস্ট/০৪-এ আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের ওই সকল দালানের ফ্লোরে বা ছাদে অবস্থান করতে দেয়া হয় নেই। ওইদিন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় আমার জিপ যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হতে আউটার স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন পুলিশ টিয়ারশেল ব্যবহার করে ও শর্টগান থেকে গুলি করে আমাদের যাত্রাকে ব্যাহত করেছিল। আমি যখন গাড়িতে উঠি তখন কয়েকটি গুলির শব্দ শুনি, তবে কারা গুলি করে বা কোন দিক থেকে গুলি হচ্ছিল তা বুঝে উঠতে পারি নাই। ঘটনার সময় এসবি’র প্রটেকশন টিমের সদস্যরা তাদের অস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও ডিএমপির প্রটেকশন দল কোনও ভূমিকা রাখে নাই। উপরোন্তু, ডিএমপি পুলিশ সদস্যরা আহতদের সাহায্য না করে সাহায্যকারীদের লাঠিপেটা করেছে। এই ঘটনায় আমার বুলেট প্রুফ গাড়িটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন
×