ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উপার্জনমুখী কর্মকা-ে সংসারে সচ্ছলতা আসছে

উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে প্রান্তিক নারীরাও ভূমিকা রাখতে পারে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১১ অক্টোবর ২০১৮

উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে প্রান্তিক নারীরাও ভূমিকা রাখতে পারে

ওয়াজেদ হীরা ॥ অভাবের সংসার, নিত্য ঝগড়া লেগেই থাকে। দিনমজুর স্বামীর অল্প আয়ের কারণে দুই মেয়েরই লেখাপড়া বন্ধ। চলে না সংসারের চাকাও। ধারদেনা করে সংসার চালাতে চালাতে অবশেষে নিজেকেই হাল ধরতে হয়েছে। টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চল কালিয়ার শ্রমজীবী নারী সুফিয়া বেগম অবলীলায় বলে যাচ্ছিলেন নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা। দারিদ্র্যের কশাঘাত হতে মুক্তি পেতে যিনি বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এখন কিছুটা স্বস্তিতেই দিন পার করছেন। জীবন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়াতে পেরে চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু ছলছল করে ওঠে। একই ইউনিয়নের বাসিন্দা নুর বানু, মরিয়ম, ইতি আক্তারের প্রতিদিনের জীবনের চিত্রও একই ধরনের। নিত্য দারিদ্র্যের চাপে অবশেষে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। বাড়তি আয়ের পথ তৈরি করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে কেউ ঋণ নিয়ে বাড়তি আয়ের পথ তৈরি করেছেন, কেউ আবার নিজের জমিতে নানা ধরনের সবজি আবাদ করে দারিদ্র্য দূর করার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। প্রান্তিক নারী নুর বানুর মতে, আমার স্বামী যা আয় করে তাতে সংসার চলে না। তাই আমিও এখন কাজ করছি। পাশাপাশি নিজে সবজি ক্ষেত করেছি, বাড়তি আয় হচ্ছে। সংসারে অভাব নেই। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে এমন লাখ লাখ নারী ছড়িয়ে আছে; যাদের কেউ দর্জির কাজ, কেউ বুনন, পার্লার, ছাগল পালন, কেউবা খাবারের ব্যবসায় জড়িত। এছাড়া গ্রামের নারী বিশেষ করে নানামুখী উৎপাদনে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। শাকসবজির পাশাপাশি হাঁসমুরগি লালন-পালন করে যোগান দিচ্ছেন পরিবারে বাড়তি আয়। প্রান্তিক নারী উপার্জনমুখী কাজে যুক্ত হওয়ার ফলে সংসারে যেমন সচ্ছলতা আসছে তেমনি দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে দেশও। ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখেন সেই স্বপ্নের সারথি হতে পারে এই প্রান্তিক নারীও। কেননা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের পরিবর্তন এসে এখন মধ্যম আয়ে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরাও মনে করছেন প্রান্তিক নারীর উপার্জনমুখী কর্মকা- ভূমিকা রাখছে উন্নয়নে। এসব নারীর অনেকেই বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী সংস্থায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করতে ঋণ নিয়ে কাজ করছেন। কেউবা স্থানীয় কোন বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কেউ ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। আবার এমনও অনেক নারী আছেন যারা ঋণ ও প্রশিক্ষণ দুটোই নিয়েছেন। যাদের মূল লক্ষ্য হলো পরিবার থেকে দারিদ্র্য দূর করা। নিজেদের জীবনমান একটু উন্নত করা, একটু স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতেই এসব করা। এতে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে নারী যেমন অবদান রাখছেন তেমনি নিজেদের সংসারে ফিরছে সচ্ছলতাও। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে (এসডিজি) বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতেও বলা হয়েছেÑ এক দশকে বাংলাদেশে দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এক সদস্য। নাম প্রকাশ না করে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের ওই সদস্য জানান, বাংলাদেশের নারী এখন অনেক সচেতন। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পাশাপাশি ঘরে-বাইরে কাজ করে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখছেন। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষিতদের পাশাপাশি নিরক্ষর নারীকে আয়বর্ধক কাজের বিষয়ে আরও ধারণা বা প্রেরণা দেয়ার কথাও বলেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পেছনে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা অন্যতম। পাশাপাশি, সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজও একটা ভূমিকা রাখছে। নারীকে নানামুখী কর্মে সংযুক্ত করার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সরকারের নানা প্রকল্প এবং এনজিওগুলোর ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম। একাধিক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনজিও থেকে ঋণ পেয়ে সেই টাকা দিয়ে নানা কাজ করছেন তারা। রাজধানীর পান্থপথে প্রতিদিন চিতইপিঠা বিক্রি করেন আসমা খাতুন। স্বামী কখনও রিক্সা চালান, কখনও দিনমজুরের কাজ করেন। তবে পিঠা বিক্রির প্রতিদিনের আয় থেকে সংসারে খরচ করতে পেরেই খুশি আসমা। তিনি বলেন, প্রতিদিন একরকম বিক্রি হয় না। তবে এই ব্যবসা করার আগে সংসারে যে কি করুণ দিন গেছেÑ আমি আর আল্লাহ জানে। রাজধানীর অনেক জায়গায় নারীকে নানা ধরনের ব্যবসা করতে দেখা যায়। রাজধানীর চেয়ে গ্রামে এই নারীর সংখ্যা অনেক বেশি, মত সংশ্লিষ্টদের। আর নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত হয়ে সংসারে উন্নয়ন করে যাচ্ছেন দূর হচ্ছে দারিদ্র্য। বর্তমান সরকার নারীর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নারীর উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। কর্মসংস্থান, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতির জন্য ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সার্বিক কর্মসংস্থানে ৮০’র বেশি পয়েন্ট অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৬ সালে ইউএন উইমেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং গ্লোবাল পার্টনারশিপের জন্য ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ এ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। প্রত্যন্ত এলাকার একাধিক গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছেন নারী। অনেক সময় বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হচ্ছে না ক্রেতা পাইকারি হিসেবে বাড়িতে গিয়েই কিনে আনছেন। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের মর্জিনা বেগম। সারাবছর সবজি উৎপাদন করে সংসারে ফিরিয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য। এবার লাউ বুনেছেন। তিনি বলেন, গতবছরও আমি লাউ বুনে লাভবান হয়েছি। আমার বাজারে নিতে হয় না। প্রতিদিনই পাইকারি ধরে ক্ষেত থেকে বিক্রি করি। মর্জিনার দেখাদেখি আশপাশের অনেকেই নানা ধরনের উৎপাদনমুখী কর্মে নিয়োজিত এখন। দেশের অনেক এলাকায় এখনও নারী সরাসরি শ্রম দেয়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে আলুর বুনন এবং ওঠানোর সময় নারী শ্রমিককে প্রচুর ব্যবহার করা হয়। মাঠ পর্যায়ের শ্রমিক আসমা খাতুন জানান, আলুর সময় যে টাকা আমাদের দেয় তা পুরুষের তুলনায় কম যদিও কাজ আমরাই বেশি করি। তবে কাজ করে টাকা পাচ্ছি এটাও অনেক কিছু। একাধিক অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যে কয়টি অভীষ্ঠে বাংলাদেশ সাফল্য লাভ করেছে দারিদ্র্য তার মধ্যে অন্যতম। আর তা দূর করতে মহিলাদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথাগুনতি দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ শতাংশ। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মাথাগুনতি দারিদ্র্যের লক্ষ্যমাত্রা মাত্রা ১৩.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে এক কোটি ৬২ লাখ নারী। এছাড়া দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্রঋণ ব্যবহারকারীও নারী। দারিদ্র্য কমে আসছে এবং সচেতনতার মাধ্যমে আরও কমবে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। তার মতে সময় পূর্বের চেয়ে অনেক পাল্টে গেছে। নারী-পুরুষ সবাই এখন কর্মমুখী। ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, নারীর ঘরের কাজকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। তবে নারী ঘরে অনেক কাজই করে থাকেন। এটি সচেতনতার বিষয়। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে প্রত্যন্ত মেয়েদের অনেক ভূমিকাই রয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা নারী এখন সচেতন হচ্ছে। ঘরের কাজ শেষে ছুটছেন বাইরের কাজেও। শিক্ষিত নারী নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিলেও প্রান্তিক নারী ভূমিকা রাখছে সংসার উন্নয়নের ক্ষেত্রে। এছাড়া একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে সবারই ভূমিকা থাকে সেখানে এটিও একটি বিবেচ্য বিষয় বলে জানান তিনি। স্ব স্ব অবস্থান থেকে নারীর এই ভূমিকা শুধু দারিদ্র্য দূর করতে নয় দেশের অগ্রযাত্রায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য প্রান্তিক নারীকে উপার্জনমুখী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হতে আরও উৎসাহ দেয়ার কথাও বলছেন।
×