ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জনপ্রিয়রাই পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন, বাদ পড়বে অর্ধশত মন্ত্রী-এমপি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১১ অক্টোবর ২০১৮

জনপ্রিয়রাই পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন, বাদ পড়বে অর্ধশত মন্ত্রী-এমপি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পেশীশক্তি, অর্থবিত্তের অধিকারী এবং গত পাঁচ বছরে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন এমন নেতারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন না। ক্ষমতাসীন দল থেকে মনোনয়ন পেতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই জনসম্পৃক্ত হতে হবে। একইসঙ্গে মনোনয়ন প্রত্যাশীকে হতে হবে শিক্ষিত-মার্জিত, থাকতে হবে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও। এসব গুণের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ত্যাগী-অভিজ্ঞ নেতারাই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য হবেন। আগামী একাদশ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকই হবে, এটা মাথায় রেখেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয় এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরাই দলের চূড়ান্ত মনোনয়নে এগিয়ে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে ফেলবে আওয়ামী লীগ। তবে এবার ভিন্ন কৌশলে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। প্রচুর অর্থবিত্ত আছে, কিন্তু এলাকায় পরিচিতি নেই, জনসম্পৃক্ততা শূন্যের কোটায়, কর্মী-সমর্থকদের খোঁজ-খবর রাখেন না, এমন নেতাদের নৌকার মনোনয়ন দেবে না দলের হাইকমান্ড। এছাড়া দলের মন্ত্রী-এমপি হয়েও গত পাঁচ বছরে যারা নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি, বিতর্কিত কর্মকা-ের মাধ্যমে এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন- এমন প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী-এমপি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় চমক দেয়ার মতো অনেক নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিনই দলের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় ও কর্মীবান্ধব নেতারাই এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন তা স্পষ্ট করেই বলছেন। নানা সভা-সমাবেশ ও দলীয় ফোরামের বৈঠকে তিনি বলেন, জনপ্রিয় এবং উইনেবল প্রার্থীই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। দল ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টকারী, নির্বাচনী এলাকায় দ্বন্দ্ব-বিভেদ সৃষ্টিকারী এমপি বা মনোনয়নপ্রত্যাশী কেউই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে যারা এলাকায় কাজ করেছেন, উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন, তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মূল্যায়ন করেছেন, জনপ্রিয় এসব নেতাই এবার দলের মনোনয়ন পাবেন। এ বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারক নেতাদের মতে, কেন্দ্র থেকে তো কোন প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যাবে না। এবার যার যার যোগ্যতায় ভোটারদের মন জয় করেই জিতে আসতে হবে। প্রত্যেককে স্ব স্ব নির্বাচনী এলাকার পুরো ভোটার তালিকা হাতে নিয়ে প্রত্যেক ভোটারের কাছে যেতে হবে। তাদের কাছে ভোট চাইতে হবে। ভোটারদের দরজায় যেতে চিন্তা করা যাবে না, কে কোন দলের। দলের যেসব নেতা-এমপি বিগত পাঁচ বছরে ভোটারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের পরিবর্তে ‘পারিবারিক বলয়’ তৈরি করে বিরাগভাজন হয়েছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কাউকে দলের মনোনয়ন দেয়ার মতো ঝুঁকি নেবে না আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে এসব আসনে একাধিক জরিপে উঠে আসা জনপ্রিয়, ত্যাগী ও পরীক্ষিত অনেক নতুন মুখকেই মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনী চমক দেখাতে পারেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন সূত্র বলছে, এবার দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একটি হলো, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা কতটা জনসম্পৃক্ত। দ্বিতীয়টি হলো, তিনি কতটা স্থানীয় নেতাকর্মী-সমর্থকবান্ধব। প্রকৃতঅর্থে জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। গত নির্বাচনে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া না হলেও এবার প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চায় না দলটির হাইকমান্ড। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে এটা ধরে নিয়েই মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রে উল্লিখিত গুণাবলী একরকম বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। এবার প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে এসব গুণ না থাকলে, যত প্রভাবশালী নেতাই হোন, তাকে মনোনয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হবে না। কারণ হিসেবে সূত্র বলছে, এবার প্রার্থী মনোয়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল এড়াতে চায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য জানান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপ সংস্থা ও দলীয় জরিপ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে মনোনয়নের একটি খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেখানে অভিযোগ ওঠা মন্ত্রী-এমপিদের আমলনামাসহ মনোনয়নপ্রত্যাশী জনপ্রিয় অনেক নতুন নেতার নাম উঠে এসেছে। এমপি না হয়েও এরই মধ্যে নির্বাচনী এলাকায় যারা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, শক্তিশালী জনসমর্থন অর্জনে সক্ষম হয়েছে তাদের নামও উঠে এসেছে এই তালিকায়। তালিকার একটি অংশজুড়ে রয়েছে নেতিবাচক ভাবমূর্তির বেশ কিছু এমপির নাম। কোন কোন আসনের এমপি দলের স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থ দেখতে গিয়ে এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, বিতর্কিত কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এসব এমপির পরিবর্তে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা অধিক জনপ্রিয় ও কর্মী-সমর্থকবান্ধব তাদের নাম সামনে উঠে এসেছে বলেও সূত্র জানায়। টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকায় প্রার্থী বাছাইর ক্ষেত্রে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে দলটির হাইকমান্ডের। অধিকাংশ আসনেই মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়ি থাকায় সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ্ব-কোন্দল-বিভেদ। মৌসুমী প্রার্থীরাও আসনগুলোতে গ্রুপিং বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অনেক আসনেই মনোনয়ন কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন দলের বিবাদমান নেতাকর্মীরা। নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপ করে অনেক জেলাতেই এসব বিভেদ-দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করা হলেও খুব একটা ফল আসেনি। এসব বিষয় মাথায় রেখে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে এবার অনেকটাই কঠিন অবস্থানে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা। দলটির সর্বোচ্চ আসন থেকেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তাকে কোন ধরনের ক্ষমা করা হবে না। দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি শাস্তিমূলক যা যা ব্যবস্থা নেয়া যায়, তার সবই করা হবে বলেও তৃণমূল নেতাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে করে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হলে ‘খবর’ আছে। প্রার্থী হতে চাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু প্রার্থী হতে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঘর করবেন না। মশারির মধ্যে মশারি টাঙ্গাবেন না। আবার যাকে মনোনয়ন দেয়া হয় তিনি বাকি প্রার্থীদের শত্রু ভাববেন না। যারা মনোনয়ন চাইবেন তাদের মার্কা হবে নৌকা। সবার আমলনামা নেত্রীর কাছে। তাই যাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। তা না হলে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া এবার নেত্রীর নির্দেশ আছে; কেউ যদি বিদ্রোহী প্রার্থী হন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। এবার কিন্তু শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর। চায়ের স্টলে বসে নিজেদের লোকদের নামে গিবত করবেন না। এটা করলে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে। আওয়ামী লীগ যদি আওয়ামী লীগের শত্রু হয়, তাহলে বাইরের শত্রু আরও সুযোগ পাবে।
×