ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২০ বছরের জন্য ঋণ সুবিধার আয়োজন রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংকের;###;ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা আরও বাড়বে ॥ বিশেষজ্ঞদের অভিমত

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বিশেষ আবদার

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১০ অক্টোবর ২০১৮

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের বিশেষ আবদার

রহিম শেখ ॥ দেশের শীর্ষ ঋণ খেলাপী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের। ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠানের তালিকার আটটিই চট্টগ্রামের। এর মধ্যে লাপাত্তা অনেক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। চট্টগ্রামের এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে তা আদায়ও করতে পারছে না অধিকাংশ ব্যাংকগুলো। এই অবস্থার মধ্যেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের আরও সুবিধা দিতে চাইছে। এবার চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপগুলোকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ২০ বছরের জন্য বিশেষ সুবিধা (ব্লক ঋণ) দেয়ার আয়োজন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত কয়েকটি বৈঠকও করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক। ফলে ভবিষ্যতে খেলাপী ঋণ আদায়ের পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের। শীর্ষ এই খেলাপীদের নাম প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই লাপাত্তা এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। চট্টগ্রামের এমন সাত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে এখন তা আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অগ্রণী ব্যাংক। নূরজাহান গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানসহ এই সাত প্রতিষ্ঠানের কাছে অগ্রণীর পাওনা এক হাজার ৯৭০ কোটি টাকার বেশি। সূত্র জানায়, খেলাপী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইলিয়াছ ব্রাদার্সের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের চট্টগ্রামের কর্পোরেট শাখার পাওনা ৪৯৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৬০ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপীর তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে ইলিয়াছ ব্রাদার্সের নাম। দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপী চট্টগ্রামের এই প্রতিষ্ঠানটি। অন্যান্য ব্যাংকের পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছিল এ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির কাছে অগ্রণীসহ ১৩ ব্যাংকের মোট পাওনা ৮৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের দাদা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানটি ইলিয়াছ ব্রাদার্সের। এ কারখানা বন্ধ রয়েছে ২০১১ সাল থেকে। এই প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারির মামলায় দুদকে হাজিরা দিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক তিন ডিএমডি মিজানুর রহমান, ওবায়দুল্লাহ আল মাসুদ এবং শামসুল ইসলাম। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্য ব্যবসায় এক সময়ের আধিপত্য বিস্তারকারী চট্টগ্রামের নূরজাহান গ্রুপ। ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় একসময় এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব থাকলেও বর্তমানে ঝিমিয়ে পড়েছে গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠান। গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। দেশের সবচেয়ে বড় এই ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী গ্রুপটির পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা এক হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখা থেকে এই ঋণ নেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ২০ বছরের জন্য ঋণ সুবিধা দেয়া হলে খেলাপী ঋণ আদায় প্রায় অসম্ভব হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের সুবিধা দেয়ার আয়োজনের অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিতর্কিত করা। এ ধরনের কর্মকা- কোনভাবেই ব্যাংকিং খাতের জন্য সুখকর হবে না। একই সঙ্গে আর্থিক খাতে অস্থিরতা আরও বাড়বে এবং সবাই এ ধরনের অনৈতিক সুবিধা চাইতে পারে বলে মত দেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ঋণ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। কারও ব্যক্তিগত সুবিধা বিবেচনা নয়, যে কোন সিদ্ধান্তই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক চূড়ান্ত হয়। এক সময় চট্টগ্রামে অগ্রণী ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে খেলাপী ঋণ আদায় বেড়েছে। ব্যাংক সব সময় খেলাপী ঋণ আদায়ে সচেষ্ট বলে তিনি জানান। যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করে তাকে পাওয়া যায়নি। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আতাউর রহমান প্রধান বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে খেলাপী ঋণ বেশি। এই অবস্থায় বিশেষ সুবিধা দেয়া হলে খেলাপী ঋণ আদায় অনেকাংশেই কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপী প্রতিষ্ঠানের তালিকার আটটিই চট্টগ্রামের। বিভিন্ন ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখা নিজেদের ব্যালান্সশীটে যে পরিমাণ খেলাপী ঋণ দেখিয়েছে বাস্তবে তার দ্বিগুণ বলে জানা গেছে। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। সে ঋণগুলো বিবেচনায় নিলে এ অঙ্কের পরিমাণ বহুগুণ বাড়বে। শ্রেণীকৃত, অবলোপনকৃত ও আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকে ধরে মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ বের করেছে টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের বৈঠকে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ব্যাংকগুলোর শ্রেণীকৃত ঋণ ১০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। আর আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে ৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার খেলাপী ঋণে। এতে ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপী ঋণ প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকগুলো নিজেদের ব্যালান্সশীটে শুধু শ্রেণীকৃত ১০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকাকে খেলাপী হিসেবে দেখাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সমস্যা ও সঙ্কট তৈরির কেন্দ্রস্থল হলো ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়। গোড়ায় সঙ্কট থাকলে শাখা-প্রশাখা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। ব্যাংকে বড় গ্রাহক ও ঋণখেলাপীদের দাপট দিন দিন বাড়ছে। এটি ঠিক চট্টগ্রামের কিছু বড় গ্রুপ এ মুহূর্তে সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তবে শুধু চট্টগ্রামের ঋণখেলাপীদের পৃথক করে বিশেষণের সুযোগ নেই। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে দেশের প্রথম সারির সব ব্যাংকই বিপত্তিতে পড়েছে। চট্টগ্রামে নতুন বিনিয়োগের কোন পরিবেশ আর অবশিষ্ট নেই। ব্যাংকের টাকায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বড় হয়েছেন। ওই ব্যবসায়ীরাই শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে বিপদে ফেলেছেন। দুই দশক ধরেই চট্টগ্রামে খেলাপী ঋণের সংস্কৃতি চলছে। হঠাৎ করে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াও বিপর্যয়ের একটি কারণ। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপী ঋণের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৪১ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৩৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ার ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এছাড়া এবি ব্যাংকের ১ হাজার ২০৮ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ১ হাজার ১০ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংক ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ৯৮৭ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৭৮৩ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ৯৩২ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ৭৭৩ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৭৪৯ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ৬৮৬ কোটি টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৬৬৩ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ৬১৫ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক ৫০১ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক ৪৭৪ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ১৯৭০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক ৫৭২ কোটি টাকা ও জনতা ব্যাংক ৪৫৩ কোটি টাকা। উত্তরা ব্যাংক ১৫২ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৮৩ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক ২৬৪ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংক ৩২২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ১১৫ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৪৮ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ২৭৬ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ১৩০ কোটি টাকা ও ব্র্যাক ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা।
×