ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি

বাবায় কইছে, আমারে বাল্যশিক্ষা বই কিন্না দিবে...

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১০ অক্টোবর ২০১৮

বাবায় কইছে, আমারে বাল্যশিক্ষা বই কিন্না দিবে...

------------------------- খোকন আহম্মেদ হীরা ------------------------- “বাবায় কইছে, আমারে বাল্যশিক্ষা বই কিন্না দিবে’- ঐতিহাসিক সেই গানের কথা আজ অনেকেই হয়ত ভুলে গেছেন। এখন অধিকাংশ বাবা বাল্যকালেই তার সন্তানের হাতে বইয়ের পরিবর্তে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য খেলনা সামগ্রী। তাই হারিয়ে গেছে বাল্যশিক্ষা ও আদর্শলিপি বইয়ের প্রচলন। ফলে বর্তমান প্রজন্ম শিশুকালের একসময়ে বহু পরিচিত বইয়ের নাম আজ ভুলে গেছে। বইপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরে শিশু, কিশোর, যুবক থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষকে বেশি বেশি বই ক্রয়, উপহার ও পড়ার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছেন। এমনকি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) নিজেও বই লিখেন ও পড়েন। বাল্যকাল থেকেই মানুষকে সভ্য হতে সহায়তা করা, ভাষা-শিক্ষা, আদব-কায়দা, জ্ঞান ও সম্মান করতে শেখানো একটি ‘বাল্যশিক্ষা’ বই খুঁজে পেয়েছেন এক জনপ্রতিনিধি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের আইডিতে ওই জনপ্রতিনিধি পোস্ট করেছেন বইয়ের প্রতিটি পাতার ছবি। কর্মদক্ষতা ও ইউনিয়নের সর্বক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বরিশাল জেলার দুইবারের শ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত গৌরনদী উপজেলার ডিজিটাল মাহিলাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বইপ্রেমী সৈকত গুহ পিকলু ওই বাল্যশিক্ষা বইকে পবিত্র ধন আখ্যা দিয়ে লিখেছেনÑ যারা কখনও এই বইটি দেখেননি বা যারা এই বই পড়েছেন তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই এই পোস্ট। ওই পোস্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গদেশ, অসম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে শিক্ষা ও যথার্থ জ্ঞান অর্জনে আদি শিশু-পাঠ্য’র জন্য বাল্যশিক্ষা বইয়ের মাধ্যমে এত সুন্দর শিক্ষার আয়োজন করে গেছেন ‘রামসুন্দর বসাক’। পরবর্তীতে বইয়ের নামানুসারে বাংলাদেশেও ‘বাল্যশিক্ষা’ নামে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। শিশুদের জন্য বর্ণপরিচয় রচনার প্রথমেই এসে পড়ে বর্ণমালার কথা। ব্রাহ্মীলিপি থেকেই বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। এ বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। পরবর্তীতে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা বর্ণমালার যথাযথ উন্নতি হয়েছে। মৌলিক উন্নয়নের পর পরবর্তীতে মাত্র কিছু সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে। তাকে প্রথমত বর্ণমালার প্রকৃতি ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হয়েছে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হালেদের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় এক শ’ বছর মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬টিই ছিল। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ?, ?, ?, এ, ঐ, ও, ঔ, অং, অঃ। বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২ তে নামিয়েছেন। তিনি ভূমিকায় লিখলেনÑ ‘বহুকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ?-কার ও দীর্ঘ ?-কারের প্রয়োজন নাই। এ নিমিত্তে ওই দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্তে ওই দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণ স্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ‘ড, ঢ, য’ এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, ড়, ঢ়, য় হয়।’ বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে মাত্র আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তাহলো ? বর্ণটি বাদ দেয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেছেন। অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসে চন্দ্রবিন্দুকেও যোগ করে দিলেন। ড, ঢ, য-এর দ্বিবিধ উচ্চারণের ক্ষেত্রে নিচে ফুটকি বা শূন্য দিয়ে নতুন তিনটি ব্যঞ্জন অক্ষর আবিষ্কার করেছেন। তাছাড়া বিদ্যাসাগর দেখলেন, ‘বাংলা ভাষায় একারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে।’ তাই এটিকেও ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেছেন। আর ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে হয় ‘সুতরাং উহা সংযুক্তবর্ণ, এজন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।’ এভাবে তার হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি। এরমধ্যে স্বরবর্ণ ?-এর মতই শুধু অন্তঃস্থ ‘ব’ বর্ণটি বাদ যায়। এখন ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি। রামসুন্দর বসাক প্রণীত ‘বাল্যশিক্ষা’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৭ সালে। প্রথমবার ছাপা হয় তিন হাজার কপি। ৪৭ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম ছিল ১ আনা ৫ পাই। চমৎকার প্রচ্ছদটি ছাপাতে ব্যবহার করা হয়েছিল কাঠের ব্লক। তৎকালীন বঙ্গদেশ ছাড়াও অসম ও ত্রিপুরা রাজ্যের শিশুরাও এই বই দিয়ে প্রথমপাঠ বিদ্যাশিক্ষা আরম্ভ করত।
×