ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তারুণ্যের অহঙ্কার নাদিয়া মুরাদ

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ৯ অক্টোবর ২০১৮

তারুণ্যের অহঙ্কার নাদিয়া মুরাদ

ছোটবেলায় প্রতিটি মানুষই স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে সে কী হবে। একটি স্থির লক্ষ্য নিয়ে সবাই যায় এগিয়ে। নাদিয়া মুরাদের স্বপ্ন ছিল একজন স্কুল শিক্ষিকা হওয়া। কিংবা নিজের একটি বিউটি স্যালুন খোলা। কিন্তু মাত্র ২১ বছর বয়সে এসে তার স্বপ্নগুলোরই কেবল অপমৃত্যু ঘটেনি, বরং ধ্বংস হয়ে গেছে তার পুরো পৃথিবীওÑ তার নির্ভরতার জায়গা তার পরিবার। নিজের জীবনটাও ছিল প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। নাদিয়া মুরাদ। পুরো নাম নাদিয়া মুরাদ বাসি তাহা। ইরাকের এক ইয়াজিদি কৃষক পিতামাতার সন্তান তিনি। সিরিয়া সীমান্তের খুব কাছাকাছি, ইরাকের উত্তরাঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রামে থাকতেন। গ্রামের নাম কোজো। সঙ্গে ছিল তার নয় ভাই ও মা। মোটামুটি সাজানো গোছানো একটি সংসারই ছিল তাদের। কিন্তু সেই সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় তাদের গ্রামে আইএস জঙ্গীরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই। সেটি ছিল ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখ। তারা ছিলেন ইরাকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইয়াজিদির অন্তর্ভুক্ত। তাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন ইয়াজিদি। কিন্তু আইসিসের জঙ্গীরা তাদের বাধ্য করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে। যারা অস্বীকৃতি জানান, তাদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়। এভাবেই বেঘোরে প্রাণ হারান নাদিয়ার ছয় ভাই আর মা-ও। তবে তিনি যেহেতু ছিলেন কম বয়সী তরুণী, তাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করা সত্তে¡ও তাকে প্রাণে মারেনি জঙ্গীরা। বরং তাকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামিক স্টেটের তথাকথিত রাজধানী মোসুলে। সেখানে তাকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়ে, পরিণত করা হয় যৌনদাসীতে এবং তিন মাস ধরে উপর্যুপরি বেশ কয়েকবার তাকে বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে বিক্রি করা হয়। তাকে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বন্দী করেছিল। ওই সময়ে প্রতিদিন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তার পরও আশা হারাননি, ছিলেন সুযোগের অপেক্ষায়। একদিন সুযোগ মেলে। প্রহরীর অসতর্কতার সুযোগে পালিয়ে আসেন। এক প্রতিবেশী পরিবারের সহযোগিতায় এলাকা ত্যাগ করেন। তারপর রুখে দাঁড়ান যৌন সহিংসতা, মানব পাচার আর মানবতাবিরোধী সকল কর্মকাÐের বিরুদ্ধে। তার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়ে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামী পুরস্কার শান্তিতে নোবেল। তিনিই প্রথম ইরাকী এমন বিরল সম্মানে ভূষিত হলেন। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে অবস্থান করছেন। ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের এই যুবতী এখন একজন মানবাধিকার কর্মী। তিন মাসের জন্য ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীরা তাকে অপহরণ করে আটকে রেখেছিল। তার নিজের ভাষ্যমতে, ‘একটা সময়ে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে প্রাত্যহিক রুটিন বলতে কেবল একটি জিনিসই ছিল, তা হলো ধর্ষিত হওয়া। বিষয়টা এমন যেন কোন একটি স্বাভাবিক দিনে শুধু ধর্ষিত হওয়াই আপনার একমাত্র কাজ।’ নাদিয়া মুরাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন নাদিয়া’স ইনিশিয়েটিভ। গণহত্যা, গণহারে নৃশংসতা, মানব পাচারের মতো অপরাধে যেসব নারী ও বালিকা বা শিশু শিকারে পরিণত হয় তার এ সংগঠন তাদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের মানসিক ক্ষতকে সারিয়ে জীবন পুনর্গঠনের জন্য কাজ করে। ২০১৫ সালের ফেব্রæয়ারি। এ সময়ই প্রথম একটি বেলজিয়ান দৈনিক পত্রিকা লা লিব্রে বেলজিককে সাক্ষাতকার দেন নাদিয়া মুরাদ। তখন তিনি এক আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছিলেন একটি কন্টেনারের ভেতর। ২০১৫ সালে তিনিসহ ১০০০ নারী ও শিশুকে জার্মানির বাদেন-উরতেমবার্গ সরকার শরণার্থী কর্মসূচীর অধীনে সুবিধা দেয়। তারা সেখানে চলে যান। সেটাই হয়ে ওঠে নাদিয়া মুরাদের নতুন ঠিকানা। মানব পাচার ও যুদ্ধ ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি বক্তব্য রাখেন ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মানব পাচারের বিষয়ে এ যাবত এটাই প্রথমবার নিরাপত্তা পরিষদকে ব্রিফ করা হয়। এ ইস্যুতে তিনি একজন এ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করছেন। তিনি মানব পাচার ও শরণার্থী বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় উদ্যোগগুলোর সঙ্গে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি এরই মধ্যে বিভিন্ন শরণার্থী ও বেঁচে থাকা মানুষদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। তাদের নির্যাতিত হওয়া, গণহত্যার কাহিনী শুনেছেন নিজ কানে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক বিভাগে বক্তব্য রাখেন এ্যাটর্নি আমাল ক্লুনি। তিনি সেখানে বলেন, আইসিস কমান্ডারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তিনি একজন মক্কেল হিসেবে নাদিয়া মুরাদকে প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেছেন ২০১৬ সালের জুনে। ওদিকে কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন নাদিয়া মুরাদ। তার পরও নিউইয়র্ক সিটিতে নিজের প্রতিষ্ঠান নাদিয়া’স ইনিশিয়েটিভ উদ্বোধন করেন তিনি। এতে যোগ দিয়েছিলেন টিনা ব্রাউন। গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের আইনগত ও অন্যান্য সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে এখান থেকে। ওই বছরেই তাকে প্রথমবারের জন্য জাতিসংঘের অধীনে ডিগনিটি অব সারভাইভারস অব হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের শুভেচ্ছাদূত বানানো হয়। ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ ফ্রাঁসিস ও আর্চবিশপ গ্যালাঘারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ৩ মে সাক্ষাত করেন নাদিয়া মুরাদ। ওই সাক্ষাতের সময় তিনি আইসিসের হাতে আটক ইয়াজিদিদের জন্য সহায়তা প্রার্থনা করেন। নাদিয়া মুরাদ তার জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিকথা। নাম ‘দ্য লাস্ট গার্ল : মাই স্টোরি অব ক্যাপটিভিটি, এ্যান্ড মাই ফাইট এগেইনস্ট দ্য ইসলামিক স্টেট।’ এটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ৭ নবেম্বর। প্রকাশক ক্রাউন পাবলিশিং গ্রæপ। এভাবেই ছুটে চলেছেন নাদিয়া। কিন্তু এ ছুটে চলা কি কোন বিজয় নিশান উড়তে থাকা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে? নাকি নিজের দুঃস্বপ্নের মতো অতীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে? কারণ যাই হোক, তিনি যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে চলেছেন, তার কোন তুলনা হয় না। তিনি তার জীবনে যে ধরনের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন, তাতে মনুষ্যত্বের ওপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি এখন তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সেই মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই। তার জন্যই মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হলেন নাদিয়া মুরাদ। ২০১৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৭ বছরের মালালা ইউসুফজাই। তার পর নাদিয়াই সর্বকনিষ্ঠ।
×