ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দর আগামীর স্বপ্নে সুরভী

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৯ অক্টোবর ২০১৮

সুন্দর আগামীর স্বপ্নে সুরভী

সোমা সুরভী জান্নাত বর্তমানে উঠে আসা তরুণ চিত্রশিল্পীদের মধ্যে এক অগ্রগণ্য নাম। ছোটবেলা থেকে রং পেন্সিল আর অঙ্কনের খাতা সঙ্গে নিয়ে এক সাংস্কৃতিক পরিমÐলে বেড়ে উঠেছেন। শিশু বয়সেই বাবা মায়ের হাত ধরে যেতেন ড্রয়িং স্কুলে। বছর আটেক অঙ্কন শিখেছেন তখনই। সে সময় থেকে ইচ্ছে ছিল জীবনে ক্রিয়েটিভ কিছু করে বড় হওয়ার। বাবা হারুন উর রশীদ পেশায় একজন প্রকৌশলী। মা হালিমা রশীদ গৃহিণী। বেড়ে ওঠার পথে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাবা মায়ের কাছ থেকে বাঁধা বা নিষেধের সম্মুখীন হননি তিনি। যদিও বাবা একবার ভেবেছিলেন সে আর্কিটেক্ট হতে পারে, কারণ সেখানেও ড্রয়িংয়ের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু তার ভাবনায় ছিল শিল্প সৃষ্টির নেশা। এ উদ্দেশ্যে ভর্তি হন চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে- অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগে ২০১৩ সালে বিএফএ এবং বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন থেকে পেইন্টিং বিভাগে এমএফএ ডিগ্রী সম্পন্ন করেন ২০১৬ সালে। একজন শিল্পী হয়ে ওঠার প্রেরণার জায়গাটিতে ছিলেন তার মা। মা শিল্পের প্রত্যেকটি ধাপ না বুঝলেও সব সময় উৎসাহ যোগাতেন তাকে। তার যে কোন নতুন ভাবনা, স্বপ্নের জায়গাটিতে তাকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন মা। প্রেরণার জায়গাটিতে আরও রয়েছেন তার শিক্ষক এবং গুণীজনেরা। পড়তে গিয়ে, শিল্প নিয়ে কাজ করতে গিয়ে যাদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন তাদের জীবনবোধ, দর্শণ তাকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এবার ১৮তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর আলোচিত প্রজেক্ট ‘বিন্দু বিসর্গ’তে সুরভীর স্থাপনা চিত্র ‘ইন্দ্রিয়ের চাষাবাস’ ভিন্ন এক বার্তা দিয়েছে দর্শকদের। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, মানুষ হিসেবে আমরা এক সময় পাশাপাশি বসবাস করতাম। সেখান থেকে নগরায়নের প্রভাবে মানুষ যতই উপরের দিকে বাসস্থান নির্মাণ করছে ততই মাটির কাছ থেকে, প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা কখনই কাম্য নয়। আর প্রকৃতিকে আপাত দৃষ্টিতে যতই সম্পর্কহীন মনে হোক না কেন প্রত্যেকটি বস্তু কোন না কোন ভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই সম্পর্কের মাধ্যমেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য বজায় রাখে। মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে এই বোধের জায়গাটা তৈরি করতে হবে। যদি প্রয়োজনে আমাদের মাটি থেকে আরও উঁচু বাসস্থানে যেতে হয় তা হলে নিজেদের স্বার্থে প্রকৃতিকেও সেখানে নিয়ে যেতে হবে। তার স্থাপনা চিত্রের ঠিক উপরের অংশে স্থাপিত ধানগাছ সে বার্তাই দেয়। তিনি এমন একজন শিল্পী যিনি পারিপার্শ্বিকতায় দেখা দৃশ্যগুলোকে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করেন তার চিত্রকর্মে। তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বোধ করি এই যে, নিজের শিল্পকর্মে শেষ পর্যন্ত তিনি আশাবাদ জিইয়ে রাখেন। এবারের ১৮তম বিনিয়ালের মূল পর্বেও অংশ নিয়েছেন, ‘ইনভার্টেড স্পেস’ শিল্পকর্ম নিয়ে। তার প্রথম একক প্রদর্শনী ‘গ্রে কন্টুরস’ অনুষ্ঠিত হয় আঁলিয়স ফ্রসেজ গ্যালারি, ঢাকায় ২০১৮তে। অংশ নিয়েছেন সপ্তম বেজিং ইন্টারন্যাশনাল আর্ট বিনিয়েল চায়না ২০১৭ সালে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এশিয়ান আর্ট বিনিয়েলে অংশ নিয়েছেন ২০১৬ ও ২০১৮তে। আমাদের শিল্প শিক্ষার একাডেমিক সুযোগ সুবিধার বিষয়ে সুরভী মনে করেন শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে একাডেমিক দিক দিয়ে আমরা যে খুব পিছিয়ে আছি তা নয়। কিন্তু আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তার ক্ষেত্রে বলব সেখানে নির্জনতার অভাব। কখনও কখনও শিল্প সৃষ্টির জন্য নিজের ভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে নিজেকে বের করে আনবার পরিবেশ নিতান্ত প্রয়োজন। এই সুযোগটা শান্তিনিকেতনে কিছুটা বেশি। আবার এটাও সত্য যে একজন শিল্পী সমাজ বিচ্ছিন্ন কেউ নন। পারিপার্শ্বিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি সব এড়িয়ে কোন বিছিন্ন দ্বীপে বাস করা শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়। এ সব কিছু মেনে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সুরভী মনে করেন প্রাইমারি থেকে শিশুদেরকে ড্রইং শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে। তিনি বলেন, আগের তুলনায় এখন গ্যালারি বেড়েছে। প্রদর্শনীও হচ্ছে। তবে তা ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখানে আটকে থাকলে আমরা এগিয়ে যাওয়ার ফলাফল থেকে পিছিয়ে পড়ব। বাংলা শিল্প প্রসারের জন্য করণীয় জায়গাটিতে সুরভী বিশ্বাস করেন আমাদেরকে প্রত্যেকটা জেলার শিল্পকলা একাডেমিগুলোতে সে অঞ্চলের শিল্পীদের নিয়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। থাকবে বিশেষ কর্মশালা। তিনি মনে করেন এর ফলে সেই এলাকার শিল্পীদের তুলে আনা সম্ভব। সমাজের কাছে উঠে আসবে শিল্পের অজানা অনেক তথ্য। তিনি আরও বলেন, ‘দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অনেক গুণী শিল্পী রয়েছেন যাদের পরিচয় হয়তো অধিকাংশ মানুষই জানে না। হয়তবা কারও শেষ জেনারেশন চলছে। তাদের কাছে রয়েছে বাংলার আদি শিল্প ভাবনা। যেমন, আমাদের কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্প, চিত্রশিল্প। সে শিল্পকে বাঁচাতে হবে। তাদের কাছ থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তারাও চান শিখিয়ে যেতে। কিন্তু আমরা তা পারছি কোথায়।’ সেখান থেকে সাধারণ জনগণ আরও বেশি শিল্পবোদ্ধা হয়ে গড়ে উঠতে পারেন। সেখানকার আর্টিস্ট কমিউনিটি তাদের কাছ থেকে শিখতে পারেন। তিনি মনে করেন শিল্পের ক্ষেত্রে একে অপরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হওয়া, নিজেদের মধ্যে আইডিয়া শেয়ার করা, সর্বোপরি একটা ইউনিটির মধ্যে থেকে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা জরুরী। আর এই কাজের জন্য দরকার বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। বাইরের দেশগুলোতে শিল্প নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বেশি। আমাদের দেশেও আছে তবে হাতেগোনা কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী এই সুবিধা পান। প্রতি বছর আমাদের অনেক শিল্পী বের হচ্ছে কিন্তু তারা সুযোগইবা পাচ্ছে কতটা? আমাদের নতুন শিল্পীদের জন্য স্টুডিওর অভাব। ফ্রিল্যান্স কাজের ক্ষেত্রে সুযোগ কম। আমরা আশাবাদী অচিরেই এসব সুযোগ পাব আমরা। সুরভী বিশ্বাস করেন সমাজ সুন্দর করতে পারে শিল্পীরাই। তবে বর্তমান সমাজকে সুন্দর, সাহিত্য ও শৈল্পিক ভাবনায় গড়ে তোলার জন্য শিল্পীদের তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে পৌঁছাতে হবে গণমানুষের কাছে। সেখানে সৃষ্টি করতে হবে তার শিল্প। শিল্পকে কেবল চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখলে চলবে না। তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। কেউ যখন রোজ একটি বিষয় দেখবে, রং দেখব কোন এক সময় তার ভাবনার গঠনও সে রকম হবে। সুরভী মনে করেন শরীরের বৃদ্ধির জন্য যেমন খাদ্য চাই তেমনি আত্মার খোরাক হচ্ছে শিল্প। তিনি এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চান যেখানে প্রতিটি মানুষ হবে শিল্পসমৃদ্ধ। তার বিশ্বাস এটি তখনই সম্ভব যখন প্রত্যেকটি শিশুকে শিল্পের স্পর্শে গড়ে তোলা হবে।
×