ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ অক্টোবর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গতকালের পর) মুজিবনগরে গিয়েও তার সঙ্গে দেখা হয় ৯নং সার্কাস এ্যাভিনিউয়ের বাংলাদেশ মিশন অফিসে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগদান করার কয়েকদিন পরে একদিন একা একা চৌরঙ্গী এলাকায় বিকেলের দিকে হাঁটছিলাম। রাস্তায় তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা। এক সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাকে জানালাম যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। খবরটি শুনে খুশি হলেন তিনি এবং কোলাকুলি করলেন আমার সঙ্গে এবং আমার কোন জরুরী কাজ না থাকলে কাছে অবস্থিত এক সাংবাদিক বাবুর অফিসে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি। আমার কোন কাজ ছিল না তখন তাই খুশি হয়েই সম্মত হলাম তার সঙ্গে তার বন্ধুর অফিসে বিশেষ করে যখন শুনলাম যে, তার বন্ধু ইউএনআই নামে একটা ভারতীয় সংবাদ সংস্থার কলকাতা অফিসের প্রধান (ব্যুরো চীফ)। মাত্র কিছুক্ষণ আলাপেই মনে হলো ভদ্রলোক তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের ভাল বন্ধু এবং তাকে বেশ আলাপী এবং অমায়িক ব্যক্তি হিসেবে মনে হলো। তার পূর্ব পুরুষ মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের লোক। একটু পরেই তার এক বন্ধুর ফোন আসল। তিনি বাংলায় কথাবার্তা বললেন এবং তাদের আলোচনায় বাংলাদেশ, জয়বাংলা বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী প্রভৃতি বিষয়ে বার বার আলাপ হচ্ছিল এবং কথা হচ্ছিল বাংলায়। ফোনটা রেখে তিনি আমাদের জানালের যে বন্ধুটির সঙ্গে তিনি কথা বললেন তিনি তার সহপাঠী এবং আকাশবাণী কলকাতার আঞ্চলিক পরিচালক। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর সাহেব অনেকটা বিনা ভূমিকায় আমার প্রশংসায় বেশ কিছু বক্তব্য দিলেন। আমি ভাল লিখি, আমার বই সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে, আমি পাকিস্তানের শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রণীত রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনে জেল খেটেছি ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে অনকটা আবদারের সুরে আরও বললেন, আপনার বন্ধুকে যাহিদ সাহেবকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং গণহত্যা বিষয়ক অনুষ্ঠানে সুযোগ দেয়ার কথাটা বলুন না উনি এখন আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। তার বন্ধু মনে হলো কথাটা খুব সিরিয়াসলি নিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বন্ধুকে ফোন করে প্রস্তাবটা দিলেন। তার বন্ধু পরের দিন সকাল এগারোটার সময় আমাকে তার অফিসে দেখা করতে বললেন। আকাশবাণীর আঞ্চলিক পরিচালকের সঙ্গে আমার তেমন বেশি কথা হয়নি। তিনি সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান প্রযোজককে ডেকে এনে তার সঙ্গে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছি বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি বিষয়ক যে কোন একটা বিষয়ে আলোচনার জন্য তাকে একটা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিন আর এভাবেই শুরু হয় আমার আকাশবাণীতে নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘জবাব দাও’-এ অংশগ্রহণের যাত্রা। ইউএনআই অফিস থেকে বের হয়ে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাবার খায়। খাবার সময় উনি আমার সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন এবং কিভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। ঠাকুর সাহেব তার আলোচনা শুরু করেন আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারে কি কি বিষয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং চলমান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা বিবেচনা করে গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে বিষয়ে তার অভিমত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে ও এই সরকারের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যকলাপ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তৎপরতা দেশী-বেদেশী গণমাধ্যম সঠিকভাবে এবং সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করা। সরকারের এসব তৎপরতার খবরাখবর দুনিয়ার কোথাও অসত্যভাবে অথবা বিকৃতভাবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেগুলোর বিষয়ে সুস্পষ্টকরণ করা এবং প্রকৃত অবস্থান বা আমাদের সপক্ষের বক্তব্যটি সঠিকভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, মুজিবনগর সরকারের অবস্থান যত বেশি শক্তিশালী হবে, স্বাধীন সার্বভৌম হবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তাদের দৈনন্দিন কর্মকা-ের মাধ্যমে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতিও হবে ততবেশি দ্রুত এবং বিশ্ব জনমত ও তত বেশি কার্যকরীভাবে এগিয়ে আসবে আমাদের সপক্ষে। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এর পরে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার কার্যক্রমে যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেন সেটা হলো আরও বেশি কার্যকরীভাবে এবং সক্রিয়ভাবে বিশ্বজনমতকে আমাদের সপক্ষে আনয়নের পক্ষে কর্মসূচী প্রণয়ন করা। তিনি খুবই সঠিকভাবে বললেন যে ভারত ও রাশিয়া যেহেতু আমাদের সপক্ষে সক্রিয়া ভূমিকা পালন করছে তাই তৎকালীন বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তৎকালীন সরকারের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে চলেছে যদিও মার্কিন জনগণ, গণমাধ্যম এবং কেনেডির মতো আরও বেশ কয়েকজন উচ্চস্তরের রাজনীতিবিদ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাই তিনি মনে করেন যে মার্কিন জনগণ কংগ্রেস ও জাতিসংঘের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের কর্মসূচী প্রমাণ করতে হবে। সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি মুসলিম প্রাধান্য দেশগুলোর ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল যেহেতু পাকিস্তান ওই সমস্ত দেশে বানোয়াট প্রচারণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলে সে দেশে ইসলাম ধর্মের কোন চিহ্ন থাকবে না, প্রবাসী সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলাম ধর্ম বিরোধী প্রচারণায় ব্যস্ত তাই ওই সমস্ত দেশের জন্য আপাতত কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে সেগুলোতে তেমন কোন ফলাফল হবে না। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বঘোষিত হত্যাকারীদের নিয়োজিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের সহযোগী হন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। কার্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্য একটা কার্যক্রম প্রণয়ন ও সেটা কার্যকরীভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একটা খসড়া তৈরি করার জন্য প্রতিরক্ষা সচিব আমাকে যে এক সপ্তাহ সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা সম্ভব হয়েছিল বিশেষত এই কারণে যে, সময়মতো বেশ কয়েক জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিমান প-িত ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা, কূটনীতিক এবং আকবর আলী খান ও ড. বেলায়েতের মতো জ্ঞানীয় সহকর্মীর আন্তরিক সহযোগিতা ও পরামর্শ পাবার কারণে। তবে খসড়াটি প্রণয়নের পূর্বে পুরো একদিন কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরিতে এবং আধাবেলা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে নানা বইপত্র ও ম্যাগাজিন পত্রিকা দেখার সুযোগ পাবার কারণেও। ইংরেজীতে তৈরি করা খসড়াটি ছিল টাইপ করা পাঁচ পৃষ্ঠার মতো, যা পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করার পূর্বে প্রতিরক্ষা সচিব মহোদয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. বেলায়েত কিছুটা পরিবর্তন/সংযুক্ত/বাদ দিয়ে চূড়ান্ত করেছিলেন, যার কপি তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইলপত্র কোথাও সংরক্ষিত থেকে থাকলে নিশ্চয়ই সেখানে পাওয়া যাবে। তবে এত বছর পরেও আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি এই কারণে যে, এত কষ্ট, পরিমশ্রম করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ ও সেটার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার খসড়া তৈরি করা এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র, বিবিসি প্রভৃতি গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। যাদের সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পালনে সমর্থ হয়েছিলাম, তাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ বিশেষ করে তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের অফিসে অনুষ্ঠিত সভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে উক্ত কার্যক্রম চালিয়ে পরিচালনার দায়িত্ব পালনের জন্য আমার নাম প্রস্তাবকারী তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা ও ফরিদপুর থেকে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ কেএম ওবায়দুর রহমানের কথা আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব আবদুস সামাদের নেতৃত্ব এবং নির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালীন দিনগুলোতে কার্যকরীভাবে সাইকোলজিক্যালের ওয়ারফেয়ার পরিচালনার মতো কঠিন দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। সামাদ সাহেব ছিলেন সত্যিকারভাবে দেশপ্রেমিক ও পরিশ্রমী একজন কর্মকর্তা, যিনি প্রতিদিন সকালে-বিকেলে খবর নিতেন, আমরা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে কি করছি এবং কি করতে যাচ্ছি আগামী দিনগুলোতে। তার শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী মহোদয়দের কাছে নিয়ে গেছেন তাদের সাক্ষাতকার গ্রহণের জন্য। স্মরণ করি আকাশবাণী কলকাতা থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘জবাব দাও’-এ অংশগ্রহণ করে মুজিবনগর সরকারের বক্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার কাহিনী যথাযোগ্যভাবে তুলে ধরার সুযোগ পাওয়ার জন্য। (সমাপ্ত) লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×