ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কার না হওয়ায় ৩শ’ পোশাক কারখানার কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৮ অক্টোবর ২০১৮

সংস্কার না হওয়ায় ৩শ’ পোশাক কারখানার কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কারখানা সংস্কারে দফায় দফায় বৈঠক করেছে সরকারী সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই)। সর্বশেষ ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয় ডিআইএফই। তাতেও কাঙ্খিত অগ্রগতি না হওয়ায় তিন শতাধিক পোশাক কারখানার রফতানি কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ডিআইএফই থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হচ্ছে। চিঠিতে মূলত কারখানার বন্ড সুবিধা সংক্রান্ত সেবা বন্ধ করার অনুরোধ জানানো হবে বলে জানিয়েছেন ডিআইএফই-এর মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও এই কারখানাগুলোতে সংস্কার কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি, কেউ কেউ তো কোন কাজই শুরু করেনি। ডিআইএফই জানিয়েছে, কোন কারখানা সাব-কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে পোশাক তৈরি করে থাকলেও ওই সুবিধাও (বন্ড ট্র্যান্সফার) বাতিল করার অনুরোধ জানানো হবে। এর মধ্যে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএভুক্ত কারখানা রয়েছে ২১৫টি। এর আগে একই কারণে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে আলাদা দু’টি চিঠিতে সদস্যভুক্ত কারখানাকে দেয়া ইউডি (ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা কাঁচামালের প্রাপ্যতার ঘোষণা) সংক্রান্ত সেবা প্রদানে নিষেধাজ্ঞার অনুরোধ জানানো হয়। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কারখানাগুলোর রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এ নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত কার্যকর করেনি বলেই জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘কারখানাগুলোকে বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও কারখানার ভবনের কাঠামো, অগ্নি কিংবা বৈদ্যুতিক নিরাপত্তায় কাঙ্খিত অগ্রগতি হয়নি। বহুবার তাদের সঙ্গে সভা করেছি, তাদের সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছে। এরপরও অনেক কারখানা তো কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। এখন কারখানার শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং দেশের ভাবমূর্তির স্বার্থেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কেননা, এসব কারখানার কোন একটিতে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হলে তার দায় পুরো গার্মেন্টস খাতকেই নিতে হবে। ইতোমধ্যে গার্মেন্টস খাতের দুটি সংগঠনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’ বন্ধের তালিকায় থাকা গার্মেন্টসগুলোর মধ্যে কোন নামকরা প্রতিষ্ঠান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এই ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান নেই। এগুলো ক্ষুদ্র গার্মেন্টস, অনেকেই সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে।’ জনাব ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘এসব কারখানা যাতে বন্ড ট্র্যান্সফার বা সাব-কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতেও কোন কাজ না করতে পারে, বন্ড কমিশনারেটকে সে অনুরোধও জানাব। যেসব কারখানার সংস্কার ২০ শতাংশের নিচে, তাদের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে কারখানাগুলো সংস্কারে কাঙ্খিত অগ্রগতি করতে পারলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।’ রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের দেয়া বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল ও এক্সেসরিজ আমদানি করতে পারে। এক্ষেত্রে কাঁচামালের প্রাপ্যতার ঘোষণা বা ইউডি অনুমোদনের ক্ষমতা পোশাক মালিকদের দুটি সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র হাতে। এ ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করতে পারে কারখানাগুলো। আর এসব কাঁচামাল আমদানি কিংবা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করার পর তা চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের এখতিয়ার বন্ড কমিশনারেটের হাতে। এসব সেবা বন্ধ থাকলে প্রকৃতপক্ষে কোন কারখানার পক্ষে রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করা একেবারেই সম্ভব নয়। এদিকে ডিআইএফইর চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কারখানার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেছে গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বিজিএমই-এর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘যেসব কারখানা সংস্কার চালিয়ে যেতে পারবে, সেগুলোর ইউডি আমরা বন্ধ করতে চাই না। আগামী সপ্তাহে ডিআইএফইর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।’ তিনি বলেন, হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা সংস্কার করতে পারবে, তাদের তো মারার মানে হয় না। আর যারা সংস্কার করতে পারবে না, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ‘এক্সিটের’ (বন্ধ করা) উপায় বের করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাদের নাম তালিকায় এসেছে, তাদের অনেকের পক্ষে যুক্তিও আছে। আমি নিজে আগামী সপ্তাহে চট্টগ্রামে যাচ্ছি, সেখানে যাদের নাম আছে, তাদের সঙ্গে বৈঠক করব। তবে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা কোনভাবে চলবে না।’ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বহু শ্রমিক হতাহতের পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানা সংস্কারের জোর দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরই ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে রফতানি করে এমন ২২শ’ কারখানা সংস্কারে এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স নামে দুটি জোট গঠিত হয়। তাদের কার্যক্রম এখন শেষ হওয়ার পথে। এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সভুক্ত কারখানাগুলোর সংস্কারে অগ্রগতি ৯০ শতাংশের ওপরে। তবে এ দুটি জোটভুক্ত ক্রেতাদের কাছে পোশাক রফতানি হয় না, এমন দেড় হাজার কারখানা সংস্কারের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের শুরুতে উদ্যোগ নেয় সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়। তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ দেড় হাজার কারখানার সংস্কার হয়েছে গড়ে এক-তৃতীয়াংশ। এ সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া, স্থানান্তর কিংবা এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সে যুক্ত হওয়া কারখানা বাদ দিয়ে এখন ৭৪৫টি কারখানার সংস্কার দেখভাল করছে ডিআইএফই। গত এক বছর ধরে দফায় দফায় সভা করেও খুব কমসংখ্যক কারখানায়ই আশানুরূপ সংস্কার হয়েছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে কারখানাগুলোকে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এ সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পরই হার্ডলাইনে গেল ডিআইএফই। ডিআইএফই’র এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এতদিন কি করেছে ? কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো ? আমার শ্রমিকরা বেকার হোক সেটা যেমন আমি চাই না, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ কোন কারখানায় কোন শ্রমিক কাজ করুক, সেটাও চাই না। আমরা বিষয়টির একটা সুষ্ঠু সমাধান চাই।’
×