ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোটা পুনর্বহাল দাবিতে মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী প্রতিবন্ধীরা আন্দোলনে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৮ অক্টোবর ২০১৮

  কোটা পুনর্বহাল দাবিতে মুক্তিযোদ্ধা আদিবাসী প্রতিবন্ধীরা আন্দোলনে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা তুলে দিয়ে সরকারী পরিপত্র জারির চারদিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বললেন, জটিলতার দায়ভার তারা নেবে না। পরিপত্র জারির পর যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তার দায়ভার নিতে হবে সরকারকেই। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন আন্দোলনকারীরা স্বাগত জানিয়েছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব এডুকেশন’ উপাধিও দিয়েছিলেন।’ এদিকে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী কোটা বহালের দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সরকারী চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বুধবার সচিব কমিটির সুপারিশই অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এরপর কোটা সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে করা আন্দোলনকারী নেতারা হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। সাধারণ অনেক শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের উদ্যোগ স্বাগত জানিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প কিছু করার পরামর্শ দিলেও আন্দোলনকারী নেতারা এ নিয়ে মুখ খোলেননি। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী কোটা বহালের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগসহ বিভিন্ন এলকায় আন্দোলন শুরু হয়। শাহবাগে চলছে অবরোধসহ নানা কর্মসূচী। আন্দোলন শুরু হয়েছে বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জেলাতেও। ঠিক এমন এক অবস্থায় রবিবার বেলা এগারোটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা বলেছে, কোটা পদ্ধতি বাতিল তারা চায়নি, চেয়েছিল সংস্কার। তাই কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির পর এখন যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সকল সরকারী চাকরিতে পাঁচ দফার আলোকে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিল। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার কোটা সংস্কার না করে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছে। তিনি বলেন, কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি তাদের আন্দোলনের আংশিক সফলতা, পরিপূর্ণ নয়। আমরা সকল সাধারণ ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিত্ব করি। তাই আমরা সবসময় পাঁচ দফার আলোকে কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়েছি। আমরা কখনোই কোটা বাতিল চাইনি। তাই এ বাতিলের কারণে উদ্ভুত সমস্যার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। এছাড়া সরকারী চাকরিতে কোন বিশেষ নিয়োগ দেয়া যাবে না। বিশেষ নিয়োগ ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না। সেইসঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতেও কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কারের আন্দোলন করতে গিয়ে যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। নিয়োগের স্বছতা নিশ্চিত করতে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বরসহ ফল প্রকাশের দাবিও জানান তারা। যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর, ফারুক হোসেন, আতাউলল্লাহ, জসিম উদ্দিন আকাশ, মশিউর রহমানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনে ফ্রি শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক বলেন, আমাদের তিনটি দাবি ছিল। ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার। এবং পাঁচ দফার আলোকে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার। আমরা কোটাপদ্ধতির বাতিল চাইনি। প্রকৃতপক্ষে যারা পিছিয়ে আছে, তাদের এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা এখনও পিছিয়ে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের যেন বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। ছাত্রসমাজের সঙ্গে প্রহসন বা চালাকি করা হলে আমরা রাজপথে তার জবাব দেব। যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন বলেন, সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত আমাদের আংশিক সফলতা, পরিপূর্ণ বিজয় নয়। এদিকে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডসহ কয়েকটি সংগঠন। রবিবারও শাহবাগ মোড়ে অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন তারা। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধী কোটা বহাল রাখার দাবিতে একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচী পালন করছেন প্রতিবন্ধীরা ও প্রতিবন্ধীদের কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আলী হোসাইন বলেন, আমরা কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপণ প্রত্যাহার দাবি করছি। আমাদের পাঁচ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল দাবি করছি। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা কর্মসূচী পালন করে যাব। বর্তমানে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোন কোটা নেই, যা আছে তা হলো প্রহসনের। প্রতিবন্ধীদের সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে কোটায় খুঁজে পাওয়া যায় না, পৃথিবীর কোন দেশে প্রথম শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু নেই-মন্ত্রী পরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের বিরুদ্ধে এমন বক্তব্যের অভিযোগ তুলে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, দেশে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এমন বক্তব্যও আপত্তিকর। এটা তার অজ্ঞতার বহিপ্রকাশ। নিজেদের দাবির কথা উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, আমাদের ছয় দফা দাবি। ১. ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল, ২. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কটূক্তির বিচার, ৩. মুক্তিযোদ্ধা পারিবারিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলার বিচার, ৫. প্রশাসনে রাজাকার ও রাজাকারদের সন্তানদের তালিকা করে বরখাস্ত করা, ৬. মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান। মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করা না হবে, ততদিন পর্যন্ত শাহবাগে প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচী ও সারা বাংলাদেশে একই কর্মসূচী পরিচালনা করা হবে। এই অবরোধ কর্মসূচীর কারণে শাহবাগের একপাশ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বাসগুলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কোটা পর্যালোচনা কমিটির সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে হেরে যাওয়ার শামিল। সচিব কমিটির সুপারিশের পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মিষ্টি বিতরণ করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে সাধারণ ছাত্র নামধারী কিছু দিকভ্রান্ত যুবককের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী এই সুপারিশের ফলে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের অপর সংগঠন আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। সংগঠনের সভাপতি হুমাযুন কবির তার প্রতিক্রিয়ায় হতাশার শুরে বলেছেন, জাতির জনকের হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা যে সুবিধা পেয়েছে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে তা বাতিল হতে পারে না। আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যার উপর এখনও ভরসা করি। তিনি অবশ্যই বিষয়টি দেখবেন। ঢাকার বাইরেও আন্দোলন ॥ সরকারী চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ফের অবরোধ করেছে ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যরা। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে সড়কটি অবরোধ করে রাখেন তারা। সংগঠনের সদস্য সচিব রতন বিশ্বাস জানান, সরকারী কোন নির্দেশনা না আশা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাবেন তারা। ঘোষিত কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ অবরোধ পালন করছেন তারা। সরকারী চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত এ অবরোধ চলবে। সরাসরি নিয়োগে প্রতিবন্ধী কোটার দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ব্যানারে অবস্থান নেয়। এসময় শিক্ষার্থীরা ১১ দফা দাবি জানায়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-সরকারী চাকরিতে বিনা শর্তে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত চাকরির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা থেকে প্রতিবন্ধী কোটা কার্যকর, সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণ প্রতিবন্ধীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি রাখা, প্রতিবন্ধী মন্ত্রণালয়, জাতীয় প্রতিবন্ধী অধিদফতর করা, সরকারী ও বেসরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শিথিল করা ইত্যাদি। আন্দোলনের আহ্বায়ক হুমায়ূন কবীর বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি প্রতিবন্ধী রয়েছে। এ বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এর আগে আমাদের জন্য মাত্র ১ শতংশ কোটা ছিল, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। সেটাও আবার তুলে দেয়া হয়েছে। তাই আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছি। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে আমরা ৫ শতাংশ কোটা দাবি জানাচ্ছি।
×