ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার দিনেই নৈরাজ্য সৃষ্টির পরিকল্পনা

১০ অক্টোবর নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৮ অক্টোবর ২০১৮

 ১০ অক্টোবর নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থানে সরকার

শংকর কুমার দে ॥ আর একদিন পর আগামী ১০ অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে নাশকতা, নৈরাজ্যের আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জঙ্গী গোষ্ঠী। দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি), রেঞ্জ ডিআইজি ও মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখার জন্য বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশের সদর দফতরের পাঠানো বার্তায় নাশকতা, নৈরাজ্যের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর হস্তে দমন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। পুলিশের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ অক্টোবরে ২১ আগস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। মামলার রায়ে যদি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতৃবৃন্দের সাজা হয়, তাহলে প্রতিবাদে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকরা রাজপথে নেমে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। ঘটতে পারে নাশকতার ঘটনা। এ কারণে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সারাদেশে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সার্বিক পরিস্থিতি সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাসহ সব জেলা, মহানগর ও বিভাগীয় শহরগুলোর নেতাকর্মীদের গতিবিধি নজরদারির মধ্যে রাখার নির্দেশনাও রয়েছে। রায়ের দিন আদালত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর সব থানা এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তায় বিশেষ সতর্কতা নেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনও বলা সম্ভব না। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী, তার পুত্র তারেক রহমান ২১ আগস্ট মামলার আসামি। মামলার রায়কে সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। ওই দিন রায়ে যদি তারেক জিয়ার সাজা হয়, তাহলে বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ রাজপথে নেমে অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। তারা যানবাহনে ভাংচুরসহ সরকারী ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নাশকতামূলক হামলা চালাতে পারে। সুযোগ পেয়ে জামায়াত-শিবিরও বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিশে ব্যাপক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি জঙ্গী গোষ্ঠীর জঙ্গীরাও সুযোগ বুঝে নাশকতা চালাতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় রেখে আগেভাগেই পরিস্থিতির ওপর নজরদারি চালাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, আগামী ১০ অক্টোবরে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পাঠানো বার্তায়। পুলিশ সদর দফতরের পাঠানো বার্তায় আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হলো অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে দুষ্কৃতকারীরা ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরের দিকে আসতে পারে। তারা ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে পারে। পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে পারে। নাশকতা করতে পারে। গণপরিবহনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে। এমনকি কেপিআইভুক্ত সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বিদ্যুত কেন্দ্র ও রেলপথে ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগও করতে পারে। সারাদেশের পুলিশ সুপারদের কাছে পাঠানো বার্তায় অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি এড়াতে (এসপি), রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কৌশলগত স্থানে নিরাপত্তা বাড়ানো, চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা, থানাসহ পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়ানো, পুলিশের সব সিসি টিভি ক্যামেরা সচল রাখা, প্রয়োজনে ক্যামেরা ভাড়া করা, যেসব স্থানে আগে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, সেসব স্থান চিহ্নিত করা, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে বাড়তি নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, টহল বা অভিযানে পুলিশ সদস্যরা যেন একা একা না যান। টহলের সময় সবাইকে একসঙ্গে থাকার কথা বলা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্যামেরা রাখতে বলা হয়েছে, যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তারা ছবি তুলে রাখতে পারেন এবং সেই ছবি আদালতে উপস্থাপন করতে পারেন। ছবি জোগাড় করতে গণমাধ্যমকর্মীদের সাহায্য নেয়ার কথাও বলা হয়। একই সঙ্গে এ ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়তে পেশাজীবী ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হলে বিএনপি আবারও রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়বে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় যখনই ঘনিয়ে আসছে, ঠিক তখনই তারা (বিএনপি) হইচই শুরু করেছে। এর মাধ্যমে তারা খুনীদের বাঁচানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সেতুমন্ত্রী বলেন, রায় হতে যাচ্ছে এতে দেশের সবাই খুশি। কিন্তু একমাত্র বিএনপি অখুশি। কারণ, তারা জানে তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী ও মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানের ১৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানানোর পর এ মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কোন নাশকতার আশঙ্কা নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার পরিবারের শেষ সদস্যকে হত্যা করার জন্যই ২১ আগস্ট হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল। এটার রায় হতে যাচ্ছে। ওই হামলায় বঙ্গবন্ধুর কন্যা আহত হলেও আমরা আইভি রহমানসহ ২২ জনকে হারিয়েছি। ওই মামলায় বিচারক যে রায় দেবেন সেই রায় অবশ্যই কার্যকর হবে। বাংলাদেশের মানুষ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরকে সবসময় ধিক্কার দিয়ে আসছে। সেজন্যই সারাবিশ্বে যখন জঙ্গীবাদের উত্থান হচ্ছিল তখন বাংলাদেশে আমরা তার মোকাবেলা করেছি। আমরা মনে করি দেশের মানুষ যেহেতু সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদকে পছন্দ করে না তাই এতে কোন কিছুই হবে না। বাংলাদেশের মানুষ আরও একটি কালো দাগ মুছে ফেলতে পারবে। গত বৃহস্পতিবার শেরে বাংলা নগরের বাণিজ্যমেলা মাঠে উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ সদর দফতরের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আগামী ১০ অক্টোবরে ২১ আগস্ট মামলার রায়কে সামনে রেখে দেশের সব জেলা, মহানগর ও বিভাগীয় শহরগুলোর পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের গতিবিধি নজরদারির মধ্যে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী ১০ অক্টোবর আদালতের রায় সামনে রেখে জেলাগুলোতে বিএনপির নেতাকর্মীরা যেন কোন সভা-সমাবেশ, মিছিল করতে না পারে পুলিশ সুপারদের সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে কেউ যদি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশ নিতে অহেতুক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার সুযোগ কাউকে দেয়া হবে না। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, আগামী ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেবে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হবে। আদালত এলাকাতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। রায়কে কেন্দ্র্র করে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সব ইউনিট প্রস্তুত থাকবে। আগামী ১০ অক্টোবরে ২১ আগস্ট মামলার রায়কে ঘিরে কেউ যাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হস্তে দমন করার জন্য প্রস্তুত। নাগরিক জীবন বিপর্যন্ত হবে, এমন কোন ঘটনা সেদিন ঘটতে দেয়া হবে না। প্রসঙ্গত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিন দিন পর ২৪ আগস্ট আইভি রহমান মারা যান। এ হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন, আহত হয়েছিলেন আরও তিন শতাধিক জন, যাদের এখন অনেকেই পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবন-যাপন করছেন।
×