ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বমানের চিকিৎসা ॥ ডাক্তারদের উপযুক্ত হতে আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ অক্টোবর ২০১৮

 বিশ্বমানের চিকিৎসা ॥ ডাক্তারদের উপযুক্ত হতে আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা প্রদানে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে চিকিৎসকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, একজন চিকিৎসকের মানুষের সেবা করাই সর্বপ্রথম কর্তব্য। চিকিৎসকরা সবচেয়ে মহৎ সেবাই দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকদের মন হতে হবে অনেক উদার, মন হতে হবে সেবার। একজন চিকিৎসক ভাল ব্যবহারের মাধ্যমে একজন রোগীর অর্ধেক রোগ সারিয়ে দিতে পারেন। সেজন্য সবাইকে সেবার মন নিয়ে মানুষকে চিকিৎসা দিতে হবে, আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসকদের সেবার মান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। যাতে আমরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। বিপুলসংখ্যক নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার পরও গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকদের না থাকার প্রবণতার ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে পরিমাণ নতুন চিকিৎসক আমরা নিয়োগ দিয়েছি, তাতে ৫০ বেডের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তত ১০ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোথাও কোথাও একজন, খুব বেশি হলে চারজন চিকিৎসক থাকেন। সেখানে ডাক্তার থাকেন না, তাহলে মানুষ সেবা পাবে কীভাবে? পদ আমরা সৃষ্টি করে দিয়েছি, কিন্তু সেখানে আমরা ডাক্তার পাই না। চিকিৎসক নিয়োগ আমরা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেন এই অবহেলা মানুষের প্রতি। নিশ্চয়ই মানুষ আপনাদের কাছ থেকে এসব আশা করে না। সেটা আমি চিকিৎসকদের ভেবে দেখতে বলব। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশেই মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। রবিবার বিকেলে গণভবনে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন আয়োজিত ‘চিকিৎসক সম্মেলন-২০১৮’-এর উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের অনেক বিত্তবান আছেন তারা একটু সর্দি-কাশি হলেই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে পারেন। তারা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিক, আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু দেশের বৃহৎ অংশই মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত। তারা চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে পারেন না। এসব মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করা মানুষ হিসেবে চিকিৎসকদের অন্যতম কর্তব্য। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশেই মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে তাঁর অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, দেশের মানুষের সেবা করা ও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য ও কর্তব্য। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই আমরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। কী পেলাম বা কী পেলাম না সেটা কখনও হিসাব করি না। দেশের মানুষকে কী দিতে পারলাম, তাঁদের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই আমার কাছে বড় কথা। সেই লক্ষ্য নিয়েই টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে আমরা সড়কপথ, রেলপথ, নৌপথ ও আকাশপথ সবক্ষেত্রেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশের জনগণ যদি আগামী নির্বাচনে আবারও ভোট দিয়ে দেশ সেবার সুযোগ দেয় তবে বাংলাদেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবই। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিশেনের সভাপতি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে চিকিৎসক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহেদ মালেক স্বপন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অভ্যর্থনা উপ-কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ কনক কান্তি বড়ুয়া ও কনফেডারেশন মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের এশিয়া ও ওয়েনিয়া অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট ডাঃ রভিনদ্রন আর নাইডু। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিকিৎসকদের জন্য ১৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বর্তমান সরকারের আমলে চিকিৎসা খাতে ব্যাপক উন্নয়ন নিয়ে করা একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর বিএমএর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করেন বিএমএর সভাপতি ও মহাসচিব। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও আমন্ত্রিত অতিথিরা বিএমএর প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই পবিত্র সংবিধানে মানুষের চিকিৎসাসেবার কথা নিশ্চিত করে গেছেন। চিকিৎসকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নত করে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীরা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে নিজেদের ভাগ্য গড়েছে, কিছু এলিট শ্রেণী তৈরি করেছে। কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তাদের কোন নজর ছিল না। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই জনগণের কল্যাণ শুরু হয়, দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে আমরা ১২ হাজার ৮৪৬ জন নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছি। আরও অনেক নতুন চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সবশেষ মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উত্তীর্ণদের মধ্যে ৬০ ভাগই মেয়ে, ছেলেরা পাস করেছে ৪০ ভাগ। আগে জেন্ডার গ্যাপের কথা বলা হতো। এখন দেখছি উল্টো চিত্র। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, এখন ছেলেদেরই একটু ভাল করে পড়াশোনা করতে হবে। বিএমএর পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেলা শেষে দাবি দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার তিন মাস আগে থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন ক্ষমতায় থাকা সরকার শুধু রুটিন ওয়ার্ক করতে পারে, অন্য কিছু করতে পারে না। তাই আপনারা (বিএমএ) যে ১৬ দফা দাবি দিয়েছেন, তা বিবেচনার করার সময় আমাদের হাতে নেই। তবে যদি দেশের জনগণ আমাদের আবারও ভোট দেয়, দেশ সেবার সুযোগ দেয়Ñ তবে আপনাদের দাবিগুলো অবশ্যই আমরা বিবেচনা করব। তাই আপনাদের দাবিগুলো আমি ফেলে দিচ্ছি না, আমাদের কাছে রেখে দিচ্ছি। তবে আমাদের কাছে কারও কোন দাবি করতে হয় না, দাবি করার আগেই আমরা তা পূরণ করি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজকে উন্নত মানের হাসপাতাল হিসেবে নতুন করে নির্মাণ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে শত বছরের পুরনো বিল্ডিং, কেউ কেউ এটাকে হেরিটেজ বলেন। কিন্তু হেরিটেজ মাথায় ভেঙ্গে পড়লে কি হবে সেটা আর কেউ ভাবে না। আমি নতুন প্লান তৈরি করেছি। অত্যন্ত আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল আমরা নির্মাণ করে দেব। ইতোমধ্যে আমরা শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করেছি। নতুন হাসপাতাল হলে এই শয্যা সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছি। ক্ষমতাকে আমরা হাতে নিয়েছি এই চিন্তা থেকে যে, জনগণের সেবা করা আমার কর্তব্য, আমার দায়িত্ব। সরকার প্রধান আরও বলেন, চিকিৎসকদের মানুষের সেবা করা সর্বপ্রথম কর্তব্য। এখন আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে ঘুরছে। দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ জায়গায় এখন ইন্টারনেটের ব্রডব্যান্ড পৌঁছে গেছে। সড়কপথ, রেলপথ, নৌ পথ, আকাশ পথ সব জায়গায় আমরা উন্নয়ন করে দিয়েছি। তাই শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশেই চিকিৎসকদের মানুষের সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। আর চিকিৎসকরা যাতে গ্রামে থেকে চিকিৎসা দিতে পারে সেজন্য প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমরা বহুতল আবাসন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি। যাতে সেটি ভাড়া নিয়ে চিকিৎসকরা থাকতে পারেন। দেশের প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তাঁর সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে দেশে একটিও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করি। এরপর আরও তিনটি বিভাগে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য রয়েছে, দেশের প্রতিটি বিভাগেই একটি করে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে আধুনিক ও উচ্চপ্রশিক্ষিত চিকিৎসক সৃষ্টির পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। আর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে কেমন পড়ানো হচ্ছে, মান বজায় রাখা হচ্ছে কি না সেদিকেও দৃষ্টি দেয়ার দরকার। প্রধানমন্ত্রী আগামী একশ’ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ কেমন হবে সে লক্ষ্য নিয়ে তাঁর সরকারের ডেল্টা প্লান-২১০০ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০২১ সালে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করব। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব ক্ষুধা, দারিদ্র্য, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জনসেবাই একজন ডাক্তারের মূল ধর্ম। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও ভুল করতে পারে। মানুষেরই ভুল হয়, ফেরেশতাদের ভুল হয় না। কিন্তু ভুলের জন্য চিকিৎসকদের ওপর হামলা কোনভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা করেছেন, সেই ঋণ তারা কোনদিন শোধ করতে পারবে না। তাই শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে চিকিৎসা সেবাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার স্বার্থেই সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে।
×