ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ৮ অক্টোবর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গতকালের পর) কেএম ওবায়দুর রহমান ॥ অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে সদ্য দেশ থেকে আসা অগণিত যুবক শ্রেণীর লোকদের কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার পাক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বাঙালী নিধন অভিযানকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করার নানা কাহিনীর খবরাখবর সংগ্রহ করার কাজে কলকাতার কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে অবস্থিত আওয়ামী লীগের অস্থায়ী অফিসে গেলে সাধারণত একজন নেতাকে প্রায় দিনই পাওয়া যেত আর তিনি হলেন সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি, আওয়ামী লীগ নেতা এবং ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত এমএনএ কেএম ওবায়দুর রহমান। তিনি যেমনিভাবে প্রায় শূন্য হাতে দেশ থেকে আসা যুবকদের আর্থিক সহায়তা ও অন্যান্য সহযোগিতা দিতেন তেমনিভাবে আমাদের মতো বাংলাদেশের ভেতরকার তখনকার পরিস্থিতির খবরাখবর সংগ্রহের জন্যও অন্যান্য কাজে যারা আসত তাদের অনেককেই আওয়ামী লীগার এই নেতার প্রশংসা করতে শুনেছি এর অফিসে। সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কর্মসূচী প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রণয়নের জন্য যাদের বক্তব্য ও সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে কেএম ওবায়দুর রহমানও ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কাজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে ৮নং থিয়েটার রোডে আসলে সাধারণত আমাদের অফিসেও আসতেন প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেব অথবা গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের সঙ্গে দেখা করতে অথবা কোন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে এবং আমাদের সঙ্গেও তখন নানা বিষয়ে আলাপ হতো ও আন্তরিকতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করতেন আমাদের কুশলাদি। ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে যখন আমাদের আলাপ হয় থিয়েটার রোড অফিসে তখন প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা ড. বেলায়েতও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আলোচনার শুরুতেই তিনি যে কথাটা আমাদের বলেছিলেন সেটার সঙ্গে আমরাও পুরোপুরিভাবে একমাত্র পোষণ করেছিলাম। সেটা ছিল যে কোন যুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার বিষয়টা এমন হতে পারে না যা সব সময়ই পূর্ব নির্ধারিত পদ্ধতি বা পন্থায় পরিচালনা করে যেতে হবে। তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তা হলো সময়, পরিস্থিতি এবং ঐ সময়কার প্রয়োজন বিবেচনা নিয়েই কর্মসূচী প্রয়ণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি প্রাধিকার হিসেবে যে বিষয়টা উল্লেখ করেছিলেন সেটা ছিল মুজিবনগর সরকার। তিনি বললেন বাংলাদেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুজিবনগর সরকার এবং এই সরকারই চলমান যুক্তিযুদ্ধসহ সবকিছু পরিচালনা করছে, পরিচালনা করছে সামরিক বাহিনী, তৎকালীন ইলিস্টার পুলিশ বাহিনী অস্থায়ীভাবে গঠিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ এবং প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও নীতিমালা (১৯৭০ সালের দেশব্যাপী সার্বজনীনভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা দলের জন্য পরবর্তী সরকার গঠন করাটা স্বাভাবিকভাবেই পুরোপুরি একটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং সরকার গঠন করার পর থেকে প্রবাসী এই মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করাসহ প্রতিটি পদক্ষেপসহ প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই ওবায়দুর রহমান সাহেবের বক্তব্য যে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া থেকে শুক্র করে প্রবাসী এই সরকারের কার্যাবলী ও গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিদেশী গণমাধ্যমে যথাযোগ্যভাবে ব্যাপকভাবে প্রচারণা করা খুবই জরুরী। তিনি আমাদের অবহিত করলেন যে এই বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুষ্ঠিত সভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনা করার জন্য অবিলম্বে একটা ইউনিট গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং প্রতিরক্ষা সচিবকে এটা যথাশীঘ্র বাস্তবায়নের জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়। আলোচনাকালে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. বেলায়েত আওয়ামী লীগ নেতার কাছে জানতে চান যে সরকার মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য, কতটা আন্তরিক ও সচেষ্টা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কি রকম ব্যবস্থা নিচ্ছেন জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা জানান যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্র সরকার শতভাগ আন্তরিক এবং সরকারের মূল কাজই হলো সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের যথার্থভাবে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দেশব্যাপী হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের প্রতিহত করা এবং ধীরে ধীরে জনগণের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে গ্রামগঞ্জ এলাকা থেকে তাদের হটিয়ে দিয়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে শত্রুমুক্ত রাখা। তবে তিনি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দৈনন্দিন সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ বিজয় গাথার কাহিনী ব্যাপকভাবে দেশে বিদেশে সীমিতভাবে প্রচারণার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। এ ব্যাপারে আমাদের প্রচারণা বিষয়ক অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনায় আমরা যারা নিয়োজিত রয়েছি তাদের অনুরোধ করেন। এমএনএ সাহেব সবশেষে যেটা পুনরায় গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেন সেটা গেল যেহেতু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সারাদেশের জনগণের যুদ্ধ, আমাদের মরাবাঁচার যুদ্ধ, একটা জাতির হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার যুদ্ধ, আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের যুদ্ধ এবং সর্বশেষ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ, তাই প্রবাসী মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার সপক্ষের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংযুক্ত করে একটা পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে যাতে অন্তর্ভুক্ত করেছে কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মোজাফফরসহ আরো কয়েকটি রাজিৈনতক দল। তবে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার দেশের ভেতরে আক্রমণকারী হানাদার পাকবাহিনী এবং গবর্নর ডাঃ মালিকের সরকার কখন কি করছে কি ঘোষণা দিচ্ছে এবং দেশের জনগণকে খুশি রাখার জন্য কখন কি পদক্ষেপ নিচ্ছে সে সব ব্যাপারে পুরোপুরিভাবে অবহিত থাকার জন্য আমাদের উপদেশ দিলেন যাতে তার অভিমত, আমাদের পক্ষে তাদের মিথ্যা, বানোয়াট প্রচারণা ও বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘোষণাসমূহের যথাযোগ্য জবাব দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়। আমাদের কাজের মান, গ্রহণযোগ্যতা, সময় উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্প্রচার ইউনিট তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস ইনফর্মেশন বিভাগ ও স্বাধীন বাংলা ভেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের সঙ্গে নিয়মিতভাবে সমন্বয় করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেন তিনি। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ॥ সাংবাদিক তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৩ সালে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্র ছিলাম। আমি তখন ঢাকার ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজে বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। তার এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৬টি ইউনিয়নের লোকেরা সম্মিলিতভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে একটা বড় রাস্তা করার কাজ হাতে নিয়েছিল এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ঢাকার তৎকালীন দৈনিক পত্রিকার প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে ট্রেনে করে নিয়েছিলেন ওই রাস্তার কাজ দেখানোর জন্য। মর্নিং নিউজের তৎকালীন নিউজ এডিটর আঃ মান্নান আমাকে পাঠান মর্নিং নিউজের রিপোর্টার হিসেবে। উনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ করতেন। সেই ১৯৬৩ সালে স্থাপিত সম্পর্ক আমার সঙ্গে তার বজায় ছিল সব সময়ই। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমএনএ হিসেবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×