ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি বায়োস্কোপ ছড়িয়ে পড়ুক

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৭ অক্টোবর ২০১৮

কৃষি বায়োস্কোপ ছড়িয়ে পড়ুক

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা (২৯তম বিসিএস) তালহা জুবাইর মাশরুর এ পর্যন্ত ১০০টি তথ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) তৈরি করেছেন। তথ্যচিত্রের মডেল হিসেবে দেখানো হয়েছে সফল কৃষকদের। তার উদ্ভাবিত কৃষি বায়োস্কোপ গ্রামে গ্রামে বড় পর্দায় (প্রজেক্টর) প্রদর্শনের পাশাপাশি স্থানীয় কেবল টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে সজনে পাতার চাষ ও গুণাগুণ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রটি ৬২ লাখের বেশি দর্শক দেখেছেন। প্রান্তিক কৃষকের জন্য তথ্য-পরামর্শের নতুন জানালা কৃষি বায়োস্কোপের উদ্ভাবকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিস্তারিত তুলে ধরা হলো। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- এস এম মুকুল ‘কৃষি বায়োস্কোপওয়ালা’ নামে আপনার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা, কেমন লাগছে। তালহা জুবাইর মাশরুর : ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ শব্দটার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে জেনে ভাল লাগছে। ব্যক্তিগত পরিচিতির চেয়ে প্রান্তিক কৃষকের নতুন জানালা কৃষি বায়োস্কোপের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ুক সেটাই চাই। কৃষি উন্নয়নে পরামর্শ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে আপনার এই অভিনব উদ্ভাবন বা প্রচারণায় কৃষকরা কিভাবে উপকৃত হচ্ছে- তালহা জুবাইর মাশরুর : কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিওগুলো দেখে ইতোমধ্যে অনেকেই কৃষিতে আগ্রহী হয়েছেন। জমি লিজ নিয়ে শুরু করছেন প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খামার। সরাসরি কৃষকরা কিভাবে আপনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন? তালহা জুবাইর মাশরুর : কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিওগুলো কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহার উপযোগী করে তৈরি করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষি অফিসারদের মাধ্যমে কৃষক প্রশিক্ষণে কিংবা সন্ধ্যার পর গ্রামে গ্রামে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শিত হচ্ছে। তাছাড়া গ্রামের চায়ের দোকানগুলোতেই ডিশের লাইন ও রঙ্গিন টিভিতে এই ভিডিওগুলো দেখানো হচ্ছে এবং দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আশার ব্যাপারটি হলো আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অনেক কৃষকই স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তাদের ফেসবুক এ্যাকাউন্টও আছে। এরফলে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও কৃষকরা ভিডিওগুলো দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। এরমাধ্যমে কৃষির সমস্যা, সমাধান ও সম্ভাবনা বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরে অনেক তথ্য জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই কৃষি বায়োস্কোপ ভিডিওগুলো দেশ বিদেশের কৃষি কাজে যুক্ত ও কৃষিতে আগ্রহীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। কৃষকরা এখন সরাসরি মোবাইলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ (বীজ, চারা, সার, মালচিং পেপার ইত্যাদি) কিংবা প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন। মজার ব্যাপার হলো- দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে সরাসরি আমার অফিসে আলোচনার জন্য আসছেন। আমিও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের সঠিক পরামর্শ প্রদানের চেষ্টা করছি। কৃষি কাজে জড়িত এসব গরিব, সরল ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মানুষদের জন্য সামান্য কিছু পরামর্শ সেবা দেয়ার মাঝেও রয়েছে অসাধারণ সুখানুভূতি। ‘কৃষি বায়োস্কোপ’- নামকরণের মাহাত্ম্য কি তালহা জুবাইর মাশরুর : ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক কৃষক প্রশিক্ষণে ৩০ জন কৃষাণ-কৃষাণীকে প্রশিক্ষণে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে কৃষি বিষয়ক কয়েকটি ভিডিও দেখাচ্ছিলাম। ভিডিও দেখানো শেষে একজন কৃষক বললেন- ‘স্যার, আমাদের এই যে বায়োস্কোপ দেখালেন, এটা যদি আমাদের গ্রামের বাজারে দেখানো যেত তাহলে আরও অনেক কৃষকের উপকার হতো।’ তখন আমি লক্ষ্য করলাম মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে দেখানো ভিডিওকে কৃষকরা বায়োস্কোপের সঙ্গে তুলনা করছেন। এরপর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে যখন প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষি তথ্যচিত্র দেখাতে গেলাম, সেখানেও কৃষকরা এটাকে আধুনিক বায়োস্কোপ হিসাবে বলতে শুরু করলেন। সেখান থেকেই ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ নামটা ব্যবহারের ভাবনা মাথায় আসে। আমি মনে করি সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল কৃষিবিদ কৃষকদের কল্যাণে কাজ করছেন তারা যদি ‘কৃষি বায়োস্কোপ’- কনসেপ্টটি অনুসরণে কৃষির নতুন নতুন লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে ছোট ছোট ডকুমেন্টরি তৈরি করে এবং কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করে তাহলে কৃষকেরা সহজেই সেগুলো থেকে উপকৃত হবে। কবে থেকে কৃষি বায়োস্কোপের যাত্রা শুরু করলেন? তালহা জুবাইর মাশরুর : ২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুলটিয়া গ্রামে প্রজেক্টর দিয়ে ‘কৃষি বায়োস্কোপ’ এর প্রথম প্রদর্শনী দেখানো হয়। এদিন বোরো ধান, ভুট্টা ও শীতকালীন সবজি চাষের কৌশল ও রোগ পোকামাকড় দমনের উপায় বিষয়ে কয়েকটি ভিডিও দেখানো হয়। স্থানীয় কয়েকজন সফল কৃষককে তথ্যচিত্রগুলোতে রাখা হয়, ফলে পরিচিতজনের মুখ থেকে কথা শুনে কৃষকরা সহজেই অনুপ্রাণিত হন। কিভাবে এই কার্যক্রমকে আরও প্রান্তিকপর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? তালহা জুবাইর মাশরুর : বর্তমান সময়ে দ্রুত বেশি মানুষের কাছে প্রচারের জন্য ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়াই জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। যেমন সজিনার বিস্ময়কর গুণাগুণ নিয়ে ‘কৃষি বায়োস্কোপে’র একটা ভিডিও কয়েক মাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ, ইউটিউবে ১২ লাখ দেখেছেন। আধুনিক কৃষি যন্ত্র কম্বাইন হার্ভেস্টার নিয়ে কৃষি বায়োস্কোপের ভিডিও দেখেছে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। এছাড়া আমের মুকুল আসার সময় কি করণীয় কিংবা ধানের ক্ষেতে বিপিএইচ বা কারেন্ট পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে করণীয়, থাই পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ বা লাভজনক তেজপাতার চাষ ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে করা ভিডিওগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এভাবেই কৃষিক্ষেত্রে টেকসই প্রযুক্তিগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমি মনে করি সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সকল কৃষিবিদ কৃষকদের কল্যাণে কাজ করছেন তারা যদি ‘কৃষি বায়োস্কোপ’- কনসেপ্টটি অনুসরণে কৃষির নতুন নতুন লাগসই ও টেকসই প্রযুক্তি নিয়ে ছোট ছোট ডকুমেন্টরি তৈরি করে এবং কৃষক প্রশিক্ষণে ব্যবহার করে তাহলে কৃষকেরা সহজেই সেগুলো থেকে উপকৃত হবে। এ পর্যন্ত আপনি কতগুলো তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, কতগুলো প্রদর্শিত হয়েছে এবং কি কি বিষয়ে- তালহা জুবাইর মাশরুর : এই পর্যন্ত ১০০টা তথ্যচিত্র তৈরি করেছি যার মধ্যে ৯৮টি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া, কৃষক প্রশিক্ষণ ও সান্ধ্যকালীন কৃষি বায়োস্কোপে প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কম্বাইন হার্ভেস্টার, সামার টমেটো, অফসিজন তরমুজ, সজিনা পাতার গুণাগুণ, স্কোয়াশ চাষ, ভার্মি কম্পোষ্ট, থাই পেয়ারা, থাই বারোমাসি আম, অ্যাভোকাডো, গ্রাফটিং প্রযুক্তি, রিপার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ইত্যাদি। বাস্তবভিত্তিক এমন প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষক সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি ও কৃষি উন্নয়নে সরকারের কাছে আপনার কোন পরামর্শ বা প্রস্তাবনা আছে কি? তালহা জুবাইর মাশরুর : আমাদের শিক্ষিত তরুণপ্রজন্ম আধুনিক কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হলে দেশের সামগ্রিক কৃষি আরও সমৃদ্ধ হবে। কৃষি যে একটা লাভজনক সেক্টর, খাদ্য উৎপাদন যে একটা মহৎ পেশা সেই বিষয়টা তাদের উপলব্ধিতে নিয়ে আসতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে এই শিক্ষিত যুবকদের হাত ধরেই দেশে আধুনিক কৃষির বিপ্লব ঘটবে। কিন্তু তাদের মোটিভেট করা কিংবা লাভজনক উচ্চমূল্য ফল-ফসলের আবাদ ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার মতো তথ্যচিত্র বা ডিজিটাল কন্টেন্টের স্বল্পতা রয়েছে আমাদের। কৃষির নানা প্রযুক্তি ও কলাকৌশল নিয়ে আরও টেকনিক্যাল ভিডিও ডকুমেন্টারি বানানো সম্ভব হলে এবং সারাদেশব্যাপী তা প্রচারের ব্যবস্থা করা হলে সাধারণ কৃষক যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তাও তৈরি হওয়ার অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। আমি মনে করি, শিক্ষিত বেকার ছেলে মেয়েদের জন্য কৃষি হতে পারে লাভজনক কর্মক্ষেত্র। আশা করি সামনের দিনগুলোতে কৃষিতে তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা বাড়বে। ‘কৃষি বায়োস্কোপের’ এই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে সহজ উপায়ে কৃষি তথ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে জাতীয়ভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সামগ্রিকভাবে কৃষি উন্নয়ন ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
×