ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৭ অক্টোবর ২০১৮

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন

শান্তিনিকেতনের ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ জ্ঞান সাধনার এক মিলন সৌধ। নিজের জীবনের শিক্ষা কার্যক্রম কবিকে কখনও সেভাবে আনন্দ আর পরিতৃপ্তি দিতে পারেনি। বিদ্যালয়ে ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অবস্থান রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিল আন্দামান দীপপুঞ্জের নির্বাসিত জীবন। শুধু তাই নয় মাতৃভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি আর ঐতিহ্র বিচ্ছিন্ন কোন ব্যবস্থা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য ফলদায়ক হয় না। জোর করে দেশীয় আবহে বিদেশি ভাষা আত্মস্থ করার মধ্যেও কোন গৌরব কিংবা কৃতিত্ব থাকে না। আবহমান বাংলার চিরায়িত কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে জ্ঞানচর্চার অনুষঙ্গ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বিশ্বের বহু জায়গা ভ্রমণ করা কবিগুরু এটাও ভাবতে কখনো দ্বিধা করেননি যে আধুনিক সময় এবং বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনাকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। নিত্য-নতুন আবিষ্কার আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী শক্তিকেও বিদ্যাচর্চার সঙ্গে একীভূত করা বিশেষ প্রয়োজন। তথ্য-প্রযুক্তির অবারিত দ্বারও শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এমন আদর্শিক চৈতন্যে এক ভিন্নধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশনা খুঁজতে লাগলেন যেখানে শুধু মাতৃভূমি আর ভাষাকেই জানা নয় গুরুত্বের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন করতে হবে অন্য দেশের সমৃদ্ধসভ্যতা, সুস্থ্য সংস্কৃতি এবং জীবন ঘনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চার আবশ্যিক উপাদান। আর সেভাবেই তৈরি করেন তাঁর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিনিকেতনের বিশাল প্রাঙ্গণে কবির আদর্শিক বোধে নির্মিত এই বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস শুরু করার ঐতিহাসিক পটভূমি প্রসঙ্গক্রমে এসেই যায়। মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬০ সালে বোলপুরে একটি জমি ক্রয় করেন। মাঝে মধ্যে তিনি এখানে আসতেন বলে একটি গৃহও নির্মাণ করা হয়। যার নাম ছিল ‘শান্তিনিকেতন’। পর্যায়ক্রমে আশপাশের পুরো এলাকাটি শান্তিনিকেতন হয়ে যায়। কালক্রমে উপসনার জন্য একটি ব্রহ্ম মন্দির তৈরি করা হয়। পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনের এই গৃহ আর মন্দির ছিল বিদ্যাচর্চার এক পবিত্র মিলন কুঞ্জ। কবির চেতনালব্ধ বোধের নবসংস্করণে ‘ব্রহ্মচর্চাশ্রম’ নামে যে বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু সময়ের মিছিলে এক সময় তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হয়। আর শুরুতেই সেখানে প্রাচীন ভারতের নৈসর্গিক বৈভবে তপোবন বিদ্যালয়ের আদলেই পথনির্দেশনা থাকে। যেখানে শুধু দেশীয় ঐতিহ্য এবং চিরায়িত বোধের আবাহন হবে না পাশাপাশি সারা বিশ্বের সামগ্রিক জ্ঞান সাধনাকেও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করা হবে। দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে শিক্ষার এই সর্বোচ্চ পীঠস্থানটি শুধু দর্শনীয়ই নয় জ্ঞান তপস্যার এক অবারিত মিলন ক্ষেত্রেও। সবুজের সমারোহে শান্তিনিকেতনের নিরবচ্ছিন্ন শুদ্ধ আবহকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কবি যেখাবে শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়সূরি নির্ধারণ করেছিলেন সেটা শুধু প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ভিন্ন ধারাই নয় মেধা ও মনন বিকাশে বিশ্বসভার এক অনবদ্য সাধনকুঞ্জ। ১৯২১ সালে ব্রহ্মচর্চাশ্রম বিদ্যালয়কে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিষিক্ত করা হয়। বর্তমানে শান্তিনিকেতনের পুরো এলাকাটি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অধীনে। সর্বভারতীয় বর্ণাশ্রম প্রথার কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ অশুভ সংকেতটি কবি কখনও মানতে পারেননি। তাই শুরুটা সেভাবে অবারিত না হলেও এক সময় তা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই বিরাট ক্যাম্পাস জুড়ে আছে শান্তিনিকেতন গৃহ, ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, কলাভবন, সঙ্গীত ভবন, পাঠ ভবন থেকে শুরু করে ডাকঘর, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার সবই পর্যায়ক্রমিকভাবে কবি নিজ হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে গেছেন। গবেষণা কেন্দ্র, পল্লী শিক্ষাভবন এবং মেলা প্রাঙ্গণের মতো উৎসব ঘনিষ্ঠ জায়গা নির্ধারণ করা আছে। এই ক্যাম্পাসে কবি নিজে থাকতেন, সৃজন দ্যোতনায় নিবিষ্ট হতেন, প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতনে পূর্ণ হতেন বলে তাঁর পরিকল্পনায় নির্মিত বাসগৃহও আছে। ‘পুনশ্চ’ এবং উদীচী’ বাড়িটি আজও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন শোভা বধন করছে একইভাবে অসংখ্য দর্শনার্থীকে আনন্দ আর কবিকে অনুভব করার মুগ্ধতায়ও নিয়ে যাচ্ছে। ‘বিশ্বভারতী’ গ্রন্থাগারটি দেশ-বিদেশের জ্ঞানচর্চার এক অনুপম পাঠাগার। শৈশব আর কৈশোরের শিক্ষাজীবন কখনও স্বস্তিদায়ক হয়নি বলে সেই চেতনায় তিনি এই কেন্দ্রীয় জ্ঞানকক্ষটি এতটাই উন্মুক্ত করেন যাতে প্রত্যেকে তার মেধা ও চৈতন্য সমৃদ্ধ করতে সব ধরনের সহায়তা পায়। আর ‘মেলা প্রাঙ্গণটি সব চাইতে আকর্ষণীয় এবং ব্যস্ততম জায়গা। এটি মূলত; দেবেন্দ্রেনাথের আমল থেকেই। তখন শুধু পৌষ মেলা হতো। আর কবির হাত ধরে সেই ‘মেলা প্রাঙ্গণ’ উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে। এখন শুধু পৌষ মেলা নয়, বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্যে শুরু হওয়া আয়োজনগুলো পর্যায়ক্রমিক ধারায় চলতে থাকে। ‘বর্ষামঙ্গল’, শরৎকে আমন্ত্রণ জানানো হেমন্তকে আবাহন, পৌষ মেলাতো আছেই। সব শেষে রঙিন বসন্তকে বর্ণাঢ্য আড়ম্বরে, উৎসবে আর আয়োজনে মুখরিত করা হয়। সঙ্গে কবির জন্মবার্ষিকীর উৎসব আর আনন্দ তো আছেই। এই মহতী অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজক থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে যায় ছাত্র-শিক্ষকসহ আশপাশের আরও অনেক জন। বিশ্ব ভারতীর ক্যাম্পাস আঙ্গিনায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে ‘বিশ্ব ভারতী প্রকাশনী।’ এখান থেকে প্রকাশিত সব ধরনের বই অনলাইনেও কিনতে পাওয়া যায়। ‘বিশ্বভারতী’র প্রকাশনায় ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ পাঠকদের কাছে এক মহামূল্যবান সম্পদ। এই বিশাল আঙিনায় নতুন করে শোভাবর্ধন করছে ‘বাংলাদেশ ভবন’। এটা প্রধানমন্ত্রী হাসিনার আর্থিক অনুদানে নির্মিত হয়। প্রায় ২৫ কোটি ভারতীয় রুপী খরচ করে এই দ্বিতল ভবনটি নির্মিত হয়। চলতি বছরের মে মাসে শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ভবনটির উদ্বোধন করেন। জাদুঘর, মিলনায়তন এবং গ্রন্থাগার তৈরির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ভবনটি নির্মিত হয়। জাদুঘরটি মোটামুটি পরিকল্পিতভাবে গোছানো হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের সৃজন ও কর্মযজ্ঞ নিয়ে এক বিরাট জায়গা নির্ধারণ করা হয়। যাতে কবিগুরুর বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক কিছুই সংরক্ষিত আছে। ‘বিশ্বভারতী’ জাদুঘরটিও রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এক অনন্য চিত্র প্রদর্শন যেখানে বিশাল ও অসাধারণ কবিকে অনেকটাই চেনা যায়।
×