ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ মতিহারের সবুজ চত্বরে প্রাণের উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৭ অক্টোবর ২০১৮

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ মতিহারের সবুজ চত্বরে প্রাণের উচ্ছ্বাস

ক্যাম্পাসে প্রথম দিন যে ভয় নিয়ে আগমন, আস্তে আস্তে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট, বালুকণার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে। ক্লাসরুম, চিরচেনা বিভাগ, চায়ের-কাপে আড্ডা, প্যারিস রোডে বন্ধুদের খুনসুটি, মধ্যরাতে গড়া ছেড়ে গান গাওয়া সবই কয়েক বছরের বিরতিতে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সেই হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো ফিরে পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনে আগত গ্র্যাজুয়েটরা। পড়াশোনা করে ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়েছেন বছর পাঁচেক আগে। সমাবর্তন উপলক্ষে ক্যাম্পাস এসেছেন শাহজাহান আলী। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, সমাবর্তন প্রতিটি ছাত্রের স্বপ্নের দিন। প্রথমে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্টপতি আবদুল হামিদ খান আসবেন শুনে খুব ভাল লেগেছিল। বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আবার দেখা হয়েছে। ফিরে গিয়েছিলাম হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতে। কত বদলে গেছে সবাই! কেউ কেউ একজন থেকে তিন চার জন হয়ে গেছে। কেউ বা এখনও একাই আছে। কেউ কেউ চাকরি করছেন কেউ বা এখনও খুঁজে চলছেন নিজ গন্তব্য। সব মিলে আবার সেই ক্যাম্পাসের সেই পুরনো দিনগুলোতে ফিরে গেছি। স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা দিয়ে ক্যাম্পাসে ছেড়েছেন, আর আসিনি। সমাবর্তনে নিবন্ধন করেছেন কিন্তু অনাগত সন্তানের আগমনের সময় খুবই নিকটবর্তী হওয়ায় অংশ নিতে পারিনি। বলছি ব্যাংক কর্মকর্তা হেলাল এ সিয়ামের কথা। সিয়াম বলেন, অনেক দিনের অপেক্ষার পর যখন সমাবর্তনের তারিখ হলো, মনের মধ্যে খুশির জোয়ার বইতে শুরু করছিল। আহা! প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, অগ্রজ, অনুজদের সঙ্গে মিলনমেলায় অংশগ্রহণ করব। অন্যরকম শিহরণ কাজ করছিল। সময় যত এগিয়ে আসছিল আমিও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পরিকল্পনা করতে থাকলাম। কি কি করব? কোথায় থাকব? বড় ভাইদের কাছ থেকে কি কি ট্রিট নিব? ইত্যাদি। হঠাৎ গত ২৪ তারিখে অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে আগমনের দিন নির্ধারিত হয়। কিন্তু সমাবর্তন ২৯ তারিখে! অন্যদিকে সাত বছরের স্বপ্ন আমাদের সন্তানের পৃথিবীতে আসার খবর, দোটানায় পড়ে গেলাম। অবশেষে শত আকাক্সক্ষার প্রিয় সন্তানের প্রাপ্তির আনন্দে সমাবর্তনে যাওয়া হলো না। সমাবর্তনের দিন গাউন পরে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে মাতিয়ে বেড়ানো হলো না! কিন্তু সন্তানটি পৃথিবীতে সুস্থভাবে আসার আনন্দে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সকল না পাওয়া নিমেষেই ভুলে গেলাম। আজ যখন কথাগুলো লিখছি তখন ছোটভাই পিযুষ ও আমার বন্ধু সেতু সাগর, নূর, শাওন, অরূপের সাহায্যে সমাবর্তনের উপকরণ আমার হাতে পৌঁছায়। আমি হাসপাতালের কেবিনে গাউন পরে আমার সন্তানকে কোলে নিয়ে ইচ্ছেমতো ছবি তুললাম। কলিজার টুকরোকে বুকের মধ্যে রেখে ছবিগুলো তোলার পরে আর কোন কষ্ট নেই। সবাই আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। ক্যাম্পাসের খবর সংগ্রহ আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন শামীম রাহমান। এমন সমাবর্তনের গল্প মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলে ধরছেন সংবাদপত্রে। একটা সময় পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ক্যাম্পাসে ছেড়েছেন। এখন সাংবাদিকতা করছেন শামীম। তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে সমাবর্তনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস খুব কাছ থেকে উপভোগ করেছি। আবার আনন্দের খবরও সংগ্রহ করেছি। সত্যি মনে হচ্ছে আজকের আনন্দ! একবারে অন্যরকম, হ্যাট আর গাউন পরার আনন্দ! গ্র্যাজুয়েট হয়ে সমাবর্তনে উপস্থিত হতে পেরে শিক্ষাজীবনের পূর্ণতা অনুভব করছি। সমাবর্তন ঘিরে ক্যাম্পাস লাল-নীল আলোয় সেজেছে। ক্যাম্পাসে এসেই প্রিয় বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্র্যাজুয়েটরা। ক্যাম্পাসের সর্বত্রই গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক, জোহা চত্বর, পুরনো ফোকলোর চত্বর, রাকসু প্রাঙ্গণ, শহীদ মিনার চত্বর, টুকিটাকি চত্বর, স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণ গ্র্যাজুয়েটদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। অনেকদিন পরে প্রিয় ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হয়ে ফেসবুকে ছবি শেয়ার করেন। পরিসংখ্যান বিভাগের গ্র্যাজুয়েট আরিফুল ইসলাম বললেন, সমাবর্তনে অংশ নেয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বিজ্ঞান ভবন, প্যারিস রোড, লাইব্রেরি, টুকিটাকি চত্বর সব জায়গায় আবার হাঁটছি। যেন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সময়ে ফিরে গেছি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে সমাবর্তনে অংশ নেয়া, পুরোটাই যেন স্বপ্নের মতো ছিল। সমাবর্তনে অংশ নিতে ক্যাম্পাসে এসেছেন আসাদুজ্জামান রিয়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলে কাটিয়েছেন ছাত্রজীবনের চারটি বছর। যেখানে শত আনন্দ, দুঃখের গল্প রয়েছে। সে হলো ঘুরে দেখেছেন। রিয়াল বলেন, স্বপ্ন ছিল আমাদের। আগে তো দেখতাম সবাইকে গাউন পরা। প্রথমবার সমাবর্তনের দিন ঘোষণা হওয়াও খুবই উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু না হওয়ায় হতাশ হয়েছিলাম। আবার সমাবর্তনের দিন নির্ধারিত হওয়ায় স্বপ্ন পূরণের আকাক্সক্ষাটা বেড়ে গেল। গাউন পরে ছবি তুলেছি, আড্ডা দিয়েছি। সমাবর্তনের সবটুকু আনন্দ উপভোগ করেছি। আসলে এই আনন্দের অনুভূতি অন্যরকম! গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, নিজেদের আত্মপরিচয়ের কথা, মাতৃতুল্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় দেশটির কথা ভুলবে না। কারণ শিকড় ভুলে গেলে কেউ বড় হতে পারে না। সমাবর্তন উচ্চতর জ্ঞানভা-ারে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করেছে। তোমরা সে বিশাল জ্ঞানরাজ্যে অবগাহণ করে বিশ্বকে আরও সমৃদ্ধ করবে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে সমাবর্তন বক্তা সমাবর্তন বক্তা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ইমেরিটাস অধ্যাপক আলমগীর মোঃ সিরাজউদ্দীন বলেন, সমাবর্তন তোমাদের শিক্ষাজীবনের যা কিছু অর্জন ও কৃতিত্ব তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষা তোমাদের চলার পথের জন্য পাথেয়, জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দিয়েছে। তোমাদের দায়িত্ব হবে তার সদ্ব্যবহার করা। তোমরা দেশসেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হবে, তোমাদের পরিবার, সমাজ, ও দেশের হিতসাধন করবে এবং দেশকে অধিকতর সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে নিয়ে যাবে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে উপাচার্য উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে সমাজের বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষিত, মার্জিত এবং ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হিসেবে মানবিক ও সৃজনশীল কাজের মধ্যে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরা। তা করতে পারলেই তারা দেশের মানুষের কাছে বোঝা নয় বরং মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত হবে। কারণ আজকের এই তরুণ গ্র্যাজুয়েটরাই বাংলাদেশের প্রাণ, তারাই আলোকিত বাংলাদেশ গড়বে।
×