ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল প্রেম

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৭ অক্টোবর ২০১৮

ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল প্রেম

ইন্টারনেট মানুষের কাজকর্ম ও যোগাযোগের ধারা পাল্টে দিয়েছে। বিনোদন থেকে রিটেইল পর্যন্ত সমস্ত শিল্প ও ব্যবসার উৎকর্ষ ঘটিয়েছে ইন্টারনেট। তবে এর সবচেয়ে সুগভীর প্রভাব হয়ত বেশিরভাগ মানুষ জীবনের সব থেকে বড় যে সিদ্ধান্তটি নিয়ে থাকে তারই ওপরÑ এবং সেটা হলো জীবনসঙ্গী নির্বাচন। ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে অনলাইনে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ধারণাটি উদ্ভট শোনাত। আজ অনেক স্থানেই এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। স্মার্টফোনের বদৌলতে ভার্চুয়াল পানশালা আজ মানুষের পকেটের মধ্যে চলে এসেছে। সেখানে কপোত-কপোতীরা অবাধে মেলামেশা করতে পারে। সামাজিক বা শারীরিক ভৌগোলিক অবস্থা এক্ষেত্রে কোন বাধা নয়। বৈশ্বিক হিসেবে কমপক্ষে ২০ লাখ নর-নারী প্রতি মাসে ডিজিটাল ডেটিং সার্ভিস ব্যবহার করে থাকে। আমেরিকায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিয়ে এখন অনলাইনে মেলামেশা ও পছন্দ হওয়া দিয়ে শুরু হয়। আমেরিকানদের কাছে বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত, পরিচয় ও আলাপ সালাপের দ্বিতীয় সর্বাদিক জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ইন্টারনেট। ডিজিটাল ডেটিং এক বিশাল সামাজিক পরীক্ষা, যা মানুষের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, একান্ত ও অপরিহার্য একটি প্রক্রিয়ার ওপর পরিচালিত হচ্ছে। এর প্রভাব সবে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ইন্টারনেটে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত বা কথাবার্তা হওয়া অফলাইনের দেখা সাক্ষাত হওয়ার ব্যাপার থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। বাস্তব জগতে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীকে পারিবারিক নেটওয়ার্কের মধ্যে কিংবা বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মী মহলের মধ্য থেকে খুঁজে নেয়া হয়। বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় বা সাক্ষাত হওয়াটাই এক স্বাভাবিক ধারা। কিন্তু অনলাইনে যেসব নারী-পুরুষের মধ্যে যোগাযোগ, বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তাদের একে অপরের অপরিচিত হওয়ার সম্ভাবনাই যথেষ্ট বেশি। ফলে ডিজিটাল উপায়ে ডেটিংয়ের ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ, বাছ-বিচার করার সুযোগ থাকে অনেক বেশি। পানশালা, অনুষ্ঠানস্থল বা অফিসে যে কোন ব্যক্তির জন্য মাত্র কয়েক দশক সম্ভাবনাময় সঙ্গী বা সঙ্গিনী যেখানে থাকতে পারে সেখানে অনলাইনে থাকে হাজার হাজার। এই যে বৃহত্তর সুযোগ এবং সেই সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতিক্রমেই শুধু ডিজিটাল সংযোগ ঘটতে পারে এই বাস্তবতার কারণেই ডিজিটাল ডেটিংয়ের বাজার অফলাইন ডেটিংয়ের বাজারের তুলনায় অনেক বিশাল হওয়ারই বেশি সম্ভাবনা। বেশিরভাগ নর-নারীর ক্ষেত্রে অবশ্য ডিজিটাল ডেটিংয়ের পরিণতি তুলনামূলকভাবে ভাল হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমেরিকায় অনলাইনে পরিচয়, দেখা সাক্ষাত ও প্রেম-ভালবাসা হওয়া নরনারীর বিয়ে বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অফলাইনে দেখা ও প্রেম হওয়া নর-নারীর তুলনায় এই শ্রেণীর দম্পতিরা নিজেদের সুখী বলে দাবি করে থাকেন। তবে ডেটিং এ্যাপকে ঘিরে যেসব নৈতিক ভীতির কথা শোনা যায় তা বহুলাংশেই অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন গবেষকরা। সামান্য যেসব তথ্য প্রমাণের অস্তিত্ব আছে তাতে দেখা যায় অনলাইনের সুযোগ বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটাকে উৎসাহিত করছে। অথচ আমেরিকায় দেখা গেছে যে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের ঠিক আগে সেখানে ডিভোর্সের হার বেড়ে গিয়েছিল। ইন্টারনেট আসার পর থেকে হ্রাস পেয়েছে। অনলাইন ডেটিং বিশেষভাবে তাদের জন্যই আশীর্বাদস্বরূপ যাদের পাত্র বা পাত্রীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অতি সুনির্দিষ্ট ধরনের চাহিদা থাকে। আমেরিকায় অনলাইন ডেটিং সমকামীদের জন্য বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছে। সেখানে ৭০ শতাংশ সমকামী অনলাইনেই তার সঙ্গী খুঁজে নেয়। ১৯৯৫ সালে ম্যাচ ডটকম নামে অনলাইন ডেটিং সাইট প্রথম চালু হয়। তবে এই সাইটটির কাজ ছিল ডেটিংয়ের ব্যাপারে নর-নারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে সাহায্য করা। এর অল্প দিন পর সানফ্রান্সিসকো বে’ এলাকায় সমকামীদের মধ্যে প্রথম অনলাইন ডেটিং চালু হয়ে যায়। তবে অচিরেই তা ছড়িয়ে পড়ে সমকামী গোষ্ঠীর বাইরেও চলে যায়। দেখা যায় এই সার্ভিস বিশেষভাবে সেই শ্রেণীর নর-নারীর জন্য বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠেছে যারা দীর্ঘদিনের দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর ডেটিংয়ের জগতে ফিরে আসার একটা উপায়ের প্রয়োজন অনুভব করছে। ২০১০-এর দশকে এই অনলাইন ডেটিং সার্ভিসগুলো ল্যাপটপ থেকে ফোনে চলে আসে। বলাবাহুল্য, তরুণরা এই মোবাইল ফোন নিয়েই বেড়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে টিনডার নামে একটি স্টার্টআপ কোম্পানি চমৎকারিত্বের সঙ্গে উদ্ভাবিত এক অতি সহজ কৌশল চালু করে যার দ্বারা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সম্ভাব্য পছন্দের সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের ছবি ভেসে উঠবে। স্রেফ ডান দিকে সোয়াইপ করলে ‘হ্যাঁ’ বোঝাবে এবং বাঁ দিকে সোয়াইপ করলে ‘না’ বোঝাবে। যখন দু’জনেই একে অপরের ছবি দেখে ডান দিকে সোয়াইপ করবে তখনই তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ঘটবে। এই কৌশলটি দারুণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ফোনভিত্তিক এই ডেটিং সার্ভিস কীবোর্ড ভিত্তিক ডিভাইসগুলোর তুলনায় অধিকতর প্রত্যক্ষ, অধিকতর ব্যক্তিগত ও অধিকতর প্রকাশ্য। সব দেশে এবং সকল শ্রেণীতে অনলাইন ডেটিং যে একই হারে ও একইভাবে অবলম্বন করা হচ্ছে তা নয়। আমেরিকানরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট এগিয়ে। জার্মানরা তুলনামূলকভাবে বেশ পিছিয়ে পড়ে আছে। ভারতে ধর্ম ও জাতপাতের পরিসীমার মধ্যে পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিয়ের এক জটিল অফলাইন বাজার দীর্ঘদিন ধরেই চালু আছে। এর একটা অংশ অনলাইনে স্থানান্তরিত হয়েছে। গত বছর এক বিরল ভারতীয় টেক সেক্টর বিয়ের বাজারকে টার্গেট করে নেমেছে। মেট্রিমনি ডটকম নামে এই সাইটটি ভাল বাজার করছে। বিশ্বব্যাপী অনলাইন ডেটিংয়ের ব্যবসার পরিমাণ ৪৬০ কোটি ডলার। ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটে চলেছে এবং অতি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে। টিনডারের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাচ গ্রুপ ২০১৭ সালে আয় করেছে ১৩শ’ কোটি ডলার যা আমেরিকায় কনডম বিক্রেতাদের বার্ষিক আয়ের সমান। টিনডারের পেয়িং গ্রাহকের সংখ্যা ৩৮ লাখ। অনলাইন ডেটিং বাজারে টিনডার সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকলেও আমেরিকায় এর প্রতিযোগীর অভাব নেই। যেমন আছে বাম্বল। এরা সারা বিশ্বেই এদের সার্ভিস বিক্রি করছে এবং একে অন্যের চাইতে উন্নততর উপায়ে করছে। ফেসবুকও এই বাজারে ঢুকে পড়েছে। অনেক ডেটিং এ্যাপের ব্যবহারকারীরা তারা কে বা তাদের পরিচয় কি তা দেখানোর জন্য ইতোমধ্যে ডেটিং এ্যাপগুলোকে নিজেদের ফেসবুক এ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ফেসবুক যা জানে তার সবই যদি কোন ডেটিং এ্যাপ জানে তাহলে সেটি ব্যবহার করলে জোরালো সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে কোন কোম্পানিই তাদের এ্যাপে কোন গোপন ডাটা যুক্ত করে তা পরিষ্কারভাবে জানায় না। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অনলাইন ডেটিংয়ে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ও মানানসই হওয়ার ব্যাপারটা মোটামুটিভাবে অধিকতর ভাল হয়। সেটা হওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে এতে পরস্পরকে পছন্দের সুযোগটা অনেক বেশি থাকে। এই সুবিধাগুলো সেই শ্রেণীর মানুষদের জন্য সবচেয়ে পরিষ্কার যাদের পক্ষে সম্ভাব্য সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে খুঁজে বের করার কাজটা নানা কারণে বেশ কষ্টকর। অবশ্য প্রেমের এই আধুনিক উপায় বা কৌশল নিয়ে সমস্যাও আছে। অনেক ব্যবহারকারী এর মধ্যে স্ট্রেস বা ধকল আছে বলে অভিযোগ করে থাকেন। শারীরিক ছবি সম্পর্কে নেতিবাচক আবেগের অস্তিত্ব ইন্টারনেটের আগে থেকেই ছিল। তবে অনলাইন ডেটিংয়ে তা আরও বর্ধিত লাভ করেছে। বিশেষ করে যখন অপরিচিত কোন নারী বা পুরুষ আকর্ষণীয়তা সম্পর্কে হঠাৎ করেই তার নিজের অভিমত দিয়ে বসে। ডিজিটাল ডেটিংয়ের সঙ্গে বিষণœতার একটা সম্পর্ক আছে। ভুয়া এ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে জচ্চুরি কেলেঙ্কারির মতো যেসব সমস্যা অন্যান্য ডিজিটাল প্লাটফর্মকে ভারাক্রান্ত করে সেই একই সমস্যা এই অনলাইন ডেটিংয়েও আছে। নতুন করে সৃষ্ট যাবতীয় ডিজিটাল ডেটিং প্রোফাইলের ১০ শতাংশ বাস্তব জগতের ব্যক্তিদের নয়। রোমাঞ্চের এই নতুন জগত সমাজের জন্য অনভিপ্রেত পরিণতিও বয়ে আনতে পারে। অনলাইন ডেস্টারদের বাছ-বিচার করার এত বেশি সুযোগ থাকে যে তারা বিভিন্ন বাধা বা প্রতিবন্ধকতাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে যে ইন্টারনেট সমধর্মী সামাজিক গ্রুপগুলোকে পাশ কাটিয়ে আন্ত বর্ণ বিবাহ বাড়িয়ে তুলছে। তবে ডেস্টাররা নিজেদের মতো করে জীবনসঙ্গী বেছে নিতে আগের চেয়ে আরও বেশি সক্ষম। তবে অনলাইন ডেটিংয়ে যেটা হয় তা হলো এই যে, স্ক্রিনে সাধারণত সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রীর ছবি, বয়স, নাম, অবস্থান ভেসে ওঠে। এগুলো আসলে যথেষ্ট তথ্য নয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে অনলাইন ডেটিং মানুষকে খুঁতখুঁতে স্বভাবের করে তুলতে পারে। কোন একটা ছবি পছন্দ না হলেই সেটাকে ডিঙিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু সেই ছবির প্রকৃত মানুষটি হয়ত মোটেও অপছন্দ হওয়ার পাত্র নয়। বরং তার সঙ্গে সরাসরি কথা বললে কিংবা তার চোখের দিকে চাইলে হয়ত পরিষ্কার হয়ে যাবে সে কত সুন্দর মনের মানুষ। অনেকে, বিশেষ করে পুরুষরা যারা টিনডার কিংবা অন্যান্য ডেটিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের আত্মমর্যাদাবোধ হ্রাস পেতে পারে আবার তা খুব বেশিও হয়ে যেতে পারে। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হ্রাস পেতে পারে সে সব পুরুষ বা মহিলার যাদের অনেকের সঙ্গে ঠিকমতো ম্যাচিং হয় না। গবেষণায়ও দেখা গেছে যে, অনলাইন ডেটিংয়ে বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে যারা প্রায়শই পুরুষদের চেয়ে অধিক রাইট সোয়াইপ, লাইক ও মেসেজ পায় তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে পারে। ছবি ও গুটিকয়েক তথ্যের ভিত্তিতে সোয়াইপ করার ব্যাপারটি অনলাইন ও মোবাইল ডেটিংকে একটা খেলায় পরিণত করেছে। মানুষ সম্পর্কে দ্রুত মতামত দেয়ার এই ব্যাপারটি তামাশায় পরিণত হতে পারে। ছেলেটার চুল বড্ড লম্বা। অতএব বাঁ দিকে সোয়াইপ। তার চোখ জোড়া সবুজ না হয়ে নীল। অতএব বাঁ দিকে সোয়াইপ। বাথিং স্যুটে তাকে দারুণ উষ্ণ দেখায়। অতএব ডানদিকে সোয়াইপ। মেয়েটার দাঁতের গঠন নিখুঁত। অতএব ডানদিকে সোয়াইপ। এসবের ভিত্তিতে জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয়ার মতো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। সূত্র : টাইম
×