ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাড়া নেয়ার পর পুরুষরা লাপাত্তা

পাহাড়কেন্দ্রিক গ্রাম এলাকায় আস্তানা গাড়ছে জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৭ অক্টোবর ২০১৮

পাহাড়কেন্দ্রিক গ্রাম এলাকায় আস্তানা গাড়ছে জঙ্গীরা

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পাহাড়কেন্দ্রিক গ্রাম্য এলাকাগুলোতে জঙ্গীরা আস্তানা গাড়ছে। পাহাড় ঘেঁষা আর গ্রামের ভবনগুলোকে তারা এখন নিরাপদ মনে করছে। আগে মাদ্রাসা কিংবা পাহাড়ী এলাকা প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হলেও এখন আবাসিক এলাকায় নিরাপদ এমন তথ্য দিচ্ছে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীরা। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত মীরসরাইয়ের উত্তর সোনাপাহাড় এলাকার মীরসরাই যুবদলের সক্রিয় সদস্য মাজাহার কন্ট্রাক্টরের একতলা সেমিপাকা ঘরে অভিযান চালিয়ে চাল উড়ে যাওয়া আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে দুই জঙ্গীর ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করেছে র‌্যাব। উদ্ধার করা হয়েছে একে-২২ সহ বিদেশী পিস্তল ও গোলাবারুদ। অভিযোগ রয়েছে, দেশে কার্যকর থাকা গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগোচরেই জঙ্গীরা পাহাড়, গ্রাম আর আবাসিক এলাকায় অবস্থান নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জঙ্গীরা সরকারী চাকরিজীবী আর প্রবাসী মালিকের বাড়ির সন্ধান করছে। এর কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) এর এক কর্মকর্তা বলেন, এই দুই ধরনের বাড়ির মালিকরা অতিরিক্ত আয়ের উদ্দেশে ভাড়াটিয়ার তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই তড়িঘড়ি করে বাসা ভাড়া দিয়ে নিজের কাজে দেশ ত্যাগ করেন। ভাড়া ছাড়া বাড়িওয়ালার আর কোন যোগাযোগ না থাকায় এই সুযোগে জঙ্গীরা গেড়ে বসছে আবাসিক এলাকাতেই। চলছে প্রশিক্ষণও। এদিকে, আইজিপির হিসেব অনুযায়ী জেএমবিসহ ৬টি জঙ্গী সংগঠন দেশে আত্মগোপনে থাকলেও সক্রিয় রয়েছে দুটি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসারুল্লাহ ইসলামী দল ও জেএমবি সক্রিয় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও তেমন অভিযান নেই। তবে আইএস নেই একথা আইজিপি নিশ্চিত করতে পারলেও জঙ্গী নির্মূল হয়েছে তা বলতে পারছেন না। ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে ঢাকার কল্যাণপুরে আবারো জঙ্গী আস্তানায় সোয়াত টিম, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র‌্যাব ও পুলিশ অভিযান ও গুলি বিনিময়ের ঘটনায় ৮ জন জঙ্গী নিহত ও এক জঙ্গী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢামেকে ভর্তির ঘটনা ঘটেছে। তবে আকস্মিকভাবে একটি ঘটনা ঘটার পর আবারও নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এরপর আবারও দেখা যায় ঢিলেঢালা অবস্থায় গোয়েন্দা সংস্থার অগোচরেই জঙ্গীরা সক্রিয় হয়েছে। এদিকে, গত বছরের ৮ মার্চ মীরসরাইতে আবাসিক ভবন থেকে জঙ্গী গ্রেফতারের ঘটনার পর একই বছরের ১৫ মার্চ সীতাকু-ের সাধন কুটিরে থাকা এক ভাড়াটিয়াকে সন্দেহ হলে পুলিশে খবর দেয় বাড়িওয়ালা। শিশুসহ দম্পতি গ্রেফতারের পর তাদের তথ্যে একই উপজেলার প্রেমতলায় ছায়ানীড়ে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। ওই দিন বিকেল ৪টা থেকে ১৬ মার্চ দুপুর পর্যন্ত ১৯ ঘণ্টার টানা অভিযানে জঙ্গীদের এক শিশু ও ৪ জঙ্গী বোমা বিস্ফোরণে নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এরপর নগরীর আকবরশাহ থানা এলাকায় দুটি আবাসিক ভবনে জঙ্গী সন্দেহে ঘেরাও করার পর অভিযানের ফলাফল ছিল শূন্য। র‌্যাব ও পুলিশের কাছে প্রদত্ত জঙ্গীদের তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশব্যাপী প্রশিক্ষণের বিশাল নেটওয়ার্ক হাতে নিয়ে জঙ্গীরা মাঠে কাজ করছে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে তাদের প্রশিক্ষণ দাতা ও নীলনক্সাকারীরা। মাত্র দুই-তিনমাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে জঙ্গীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গী হামলার নীলনক্সা তৈরি করেছে। তবে চুপসে আছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো। চরম দায়িত্বহীনতার মধ্যে তদন্তসংস্থাগুলো কাজ করায় ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসের বিশ্লেষণে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে নির্মম জঙ্গী হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে তেমনি মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে ওই বছরের রমজানের ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। এরপর একই বছরের ২৭ জুলাই আবারও ঢাকার কল্যাণপুরে আবাসিক এলাকায় জঙ্গী আস্তানার সন্ধানের পর আতঙ্কিত এখন বাসাবাড়ির মালিকরা। গত বছরের ৮ মার্চ মীরসরাই ও ১৫ মার্চ সীতাকু-ে এবং ২৪ মার্চ সিলেটে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান ও বোমা বিস্ফোরণে জঙ্গী নিহতের ঘটনার মধ্যদিয়ে জঙ্গীদের সক্রিয়তার মেসেজ পৌঁছে গেল দেশবাসীর কাছে। অভিযানে গ্রেফতাকৃতরাই তথ্য দিয়েছে জঙ্গীরা এখন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীদের টার্গেট করছে। ফলে জঙ্গীদের মধ্যে এখন মহিলা জঙ্গীর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১০ সালে কক্সবাজারে প্রায় ৮ হাজার জঙ্গী সদস্যদের প্রশিক্ষণের পর সনদও দেয়া হয় কিন্তু কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঐ তথ্য পেয়েছে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে হালিশহরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একই পরিবারের ৩ জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর। র‌্যাব সেভেনের জিজ্ঞাসাবাদে তখন বেরিয়ে আসে জঙ্গীরা কিভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। জঙ্গীদের সংরক্ষণে রয়েছে একে-৪৭ রাইফেল প্রশিক্ষণের ভিডিও চিত্র, সিরিয়ায় আইএসআই-এর জঙ্গী প্রশিক্ষণ, আল নুসরা ট্রেনিং ভিডিও, আল কায়েদার ট্রেনিং ভিডিও, হামাস ও হিজবুল্লাহ গেরিলার ট্রেনিং ভিডিও, আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের প্রশিক্ষণ ভিডিও। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় থাকা এসএসএফ এর ট্রেনিং ভিডিও ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ভিডিও চিত্র পাওয়া গেছে তাদের কাছ থেকে। এছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করার ভিডিও, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিসহ দেশের উচ্চ পর্যায়ের মানুষদের অপহরণ ও নির্যাতনের ভিডিও চিত্র, ওসামা বিন লাদেন এবং আইমান আল জাওয়াহিরির বক্তব্য ও সাক্ষাতকার। আফগান যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার দৃশ্য ভিডিও আকারে দেখিয়ে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
×