ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইত্যাদির সচিত্র প্রতিবেদন

নীলফামারীতে তৈরি পরচুলা ব্যবহার করেন হলিউডের তারকারা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৭ অক্টোবর ২০১৮

নীলফামারীতে তৈরি পরচুলা ব্যবহার করেন হলিউডের তারকারা

সমুদ্র হক ॥ বিটিভিতে প্রচারিত অয়োময় ধারাবাহিক নাটকে আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে একটি সংলাপ ছিল ‘আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করি না’। নূর মন্ত্রী হওয়ার পর কি কম কথা বলছেন! হানিফ সংকেত এই প্রশ্নের সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন যোগ করেন, আসাদুজ্জামান নূর যখন অভিনেতা ছিলেন তখন আর্থিকভাবে লাভবান ছিলেন, না মন্ত্রী হওয়ার পর আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন! মঞ্চে এ ধরনের প্রশ্ন শোনার পর নূর বললেন, আমি এই ভয়টি করেছিলাম হানিফ সংকেত আমাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন। তারপর উত্তর দিলেন ‘যখন অভিনেতা ছিলাম তখন বেশ রোজগার করতাম। মন্ত্রী হওয়ার পর রোজগার কমে ব্যয় বেড়েছে।’ তবে তিনি কথা কম বলেন না বেশি বলেন এর উত্তরে হেসে বলেন ‘বুঝে নিতে হবে’। সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে হানিফ সংকেতের এমন আনন্দঘন একটি পর্ব ছিল নীলফামারীতে ধারণকৃত ইত্যাদির অনুষ্ঠানে। যা বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডে প্রচারিত হয় ৫ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটায়। দর্শক শ্রোতাদের মন্তব্য, ইত্যাদি বরাবরই ভাল হয়। মান এখনও ধরে রেখেছে। তবে এবারের অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যাধিক আকর্ষণীয়। ইতিহাস, অনেক তথ্যের ভা-ার, দেশের উন্নয়ন, নীরবে এগিয়ে চলার অগ্রগতি, নারী উন্নয়ন, মঙ্গা দূর, বহু বছর পর প্রবাসীর আপনজনকে ফিরে পাওয়া, নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়ি ও জীবন প্রবাহ, আর স্যাটায়ারধর্মী উন্নত হালকা রম্য আলেখ্যে এবারের ইত্যাদি দর্শক শ্রোতাদের মুগ্ধ করে হৃদয় ভরিয়ে প্রমাণ করল ইত্যাদির বিকল্প ইত্যাদি। যারা ভাব নিয়ে বলেন ‘আরে এই দেশে কী ভাল অনুষ্ঠান হয়’ তাদের কথাকে ওভার বাউন্ডারি করে উড়িয়ে দিলেন হানিফ সংকেত। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪শ’ কিলোমিটার উত্তরে হিমালয় পাদদেশীয় নীলফামারীতে ধারণকৃত এবারের ইত্যাদি শুরু হয় নীলকরদের ইতিহাস দিয়ে। একই সঙ্গে একবিংশ শতকে কিভাবে নীলচাষ অর্থকারী ফসল হয়েছে তা তুলে ধরা হয়। নীলের পাতা রিফাইন করে তিন ধরনের নীল উৎপাদন হয় তার সচিত্র বর্ণনা দেন নিখিল রায়। উত্তরা এক্সপোর্ট প্রোসেসিং জোনে (ইপিজেড) ধারণকৃত ইত্যাদির প্রথম গানে নীলফামারীর ঐতিহ্যের বিভিন্ন বিষয়ে বর্ণনা দেয়া হয়। নিকট অতীতের মঙ্গা (তীব্র অভাব) কিভাবে দূর হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন কতটা হয়েছে তার প্রতিবেদনে দেখা যায়- ইপিজেডের শ্রমিকরা যারা আগে সাইকেলে চেপে আসত তাদের বেশিরভাগই এখন মোটরসাইকেলে চড়ে আসছে। যেখানে নারী শ্রমিকের হার ৭০ শতাংশ। অনেকেই জানে না উত্তরা ইপিজেডে সিনথেটিক ফাইবার ও মানব চুলে তৈরি হচ্ছে বিশ^খ্যাত উইগ (পরচুলা)। যার বেশিরভাগই চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডে। হলিউডের অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী নীলফামারীর তৈরি উইগ ব্যবহার করছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় চশমা কারখানা এই ইপিজেডে। এই ইপিজেডে তৈরি হচ্ছে রেপ্লিকা মোটরগাড়ি। বিএমডাব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ ইম্পালা ক্যাডিলাকে গাড়ির মডেল পাল্টাবার আগে রেপ্লিকা গাড়ি তৈরি করা হচ্ছে নীলফামারীতে। বিশ^খ্যাত লেদারের ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক ওয়ালেটসহ নানা সামগ্রী তৈরি হচ্ছে সেখানে। রফতানি হচ্ছে বিদেশে। ব্রিটিশ শাসনামলে সৈয়দপুরে ১শ’ ১০ একর ভূমির ওপর স্থাপিত হয় তৎকালীন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে কারখানা। কিভাবে রেল কম্পার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে তা দেখানো হয়। বর্তমানে রেলের ১২ হাজার খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। মেরামত করা হচ্ছে রেলগাড়ির চাকা। ২০০১ সালে নির্মিত হয় বিমানবন্দর। যা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায়। ১৮৬৩ সালে চীনামাটিতে নির্মিত মসজিদটির নাম চিনি মসজিদ, সেদিনের নীলকুঠি, ৫৩ দশমিক ৯ একর ভূমির ওপর পর্যটক ও পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রমের নাম কিভাবে ১৯৭৯ সালে নীলসাগর হলো তা জানা গেল। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন কোচবিহার থেকে নীলফামারীর ডিমলার চিকনমাটি গ্রামে কিভাবে এলেন। একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিভাবে পরিচয় হলো ওই গ্রামের লুৎফুন্নেছার সঙ্গে। তারপর লুৎফুন্নেছার সঙ্গে প্রণয় এবং পরে পরিণয়ে আবদ্ধ হলেন আব্বাস উদ্দিন। তার বর্ণনা দিলেন লুৎফুন্নেছার ভাই (বরেণ্য শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের মামা)। বিদেশী পর্বে এবারের বিষয় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অবিস্মরণীয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। দেখানো হলো ১৯৪৫ সালে নির্মিত নেলসন ম্যান্ডেলা তার স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলার বাড়ি। তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, আটলান্টিক মহাসাগরের ৬ কিলোমিটার ভেতরে একটি দ্বীপে নেলসন ম্যান্ডেলার কারাগার, যে কারাগারে ম্যান্ডেলার বন্দী জীবনের ২৭ বছরের ১৯৬৪ সাল থেকে ১৮ বছর ছিলেন ৮ ফুট বাই ৭ ফুট কক্ষে ৪৬৬ নম্বর কয়েদী হয়ে। সেই কারগারকে ঘিরে বর্তমানে গড়ে ওঠা বিশে^র অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। যে দ্বীপকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তার বর্ণনা। সেই দেশের রাজধানীতে ম্যান্ডেলা স্কয়ারের দৃষ্টিনন্দন জাদুঘরসহ দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস তুলে ধরা হয়। একটি আবেগঘন রিপোর্টিং পর্ব ছিল ইত্যাদিতে। এর আগে একটি পর্বে প্রচারিত হয় ১৯৭৮ সালে এ দেশের দিনমজুরের পাঁচ বছরের মেয়ে আনোয়ারাকে একটি মাতৃসদন থেকে নেদারল্যান্ডসের এক পরিবার দত্তক নিয়ে যান। আনোয়ারা এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশে এসে তার পরিবারকে খোঁজে। সে সময় ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আনোয়ারাকে নিয়ে একটি পর্ব প্রচারিত হয়। এই পর্বটি দেখে ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ের শ্যামল দত্ত চিনতে পারেন ও হানিফ সংকেতের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে আনোয়ারার ভাই ছুটু মিয়া ও বোন ছলিমন্নেছার ডিএনএ সংগ্রহ করে পাঠানো হয় নেদারল্যান্ডসে। ফলাফল মিলে গেলে জানানো হয় আনোয়ারাকে। কিছুদিন আগে আনোয়ারা, তার স্বামী টমাস ও তাদের দুই কন্যা বাংলাদেশে এসে গফরগাঁয়ে গিয়ে ৪০ বছর পর ফিরে পান তার স্বজনকে। এই আনন্দের আবেগের অশ্রুজলে সিক্ত হয় গফরগাঁও। আনোয়ারা আশ^াস দেন তার ভাই-বোনদের তিনি যতটা সম্ভব সহযোগিতা করবেন। ইত্যাদির স্যাটায়ারধর্মী নিয়মিত পর্বও ছিল আকর্ষণীয়। মামা ভাগ্নের ভার্চুয়াল জগত নিয়ে ব্যবসা, মাল্টি কোচিং সেন্টারের নামে যা হচ্ছে, গণমাধ্যমের নামে গণ পরামর্শক সেজে কি করা হচ্ছে, নিজের বেলা ষোল আনা অন্যের বেলা নাই এমন প্রবাদে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্টের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর আলাপন, দাম্পত্য জীবনের কলহ স্মার্ট ফোনে ভিডিও করে দেখা, নানি-নাতির পর্বে ভুল কথা ধরা। গলা ভাল নেই (হবে কণ্ঠ ভাল নেই), নিজেদের মধ্যে স্যরি বলা আর ডাক্তারের স্যরি বলা বেশ পার্থক্য কথাগুলো থাকে নানি-নাতি পর্বে। ভাওয়াইয়া গান, যদি বন্ধু যাবার চান ঘারের গামছা থুইয়া যান রে.....নীলফামারীর আঞ্চলিক ভাষায় গানের কিছু কথা, যেমন বাহপু চ্যাংরা রে জলপাই পাড়িয়া দে, গ্রামের কিছু জোড়া শব্দ যেমন ক্যররত কি কুররত, হ্যচ্চত কি হুচ্চত, ফ্যাসসত কি ফ্যাসসত বেশ আনন্দ দিয়েছে। পারিবারিক আবহে শিশুদের সঙ্গ দেয়ার বিষয়টি মনযোগ কেড়েছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ, আমাদের দেশ কতটা এগিয়ে গিয়েছে, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরাসহ বহুমাত্রিক সংযোজনে ইত্যাদির এই আয়োজন ছিল অন্যগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম। অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামানকে (যার বাড়ি নীলফামারী) জিজ্ঞেস করেন, মন্ত্রী হওয়ার পর দেশের অপসংস্কৃতি রোধে কি কাজ করেছেন! উত্তরে নূর বলেন, যেদিন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন সেই দিন থেকেই তিনি সরকারী দায়িত্বে অপসংস্কৃতি রোধে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এই কাজ করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্মিলিতভাবে অপসংস্কৃতি রোধে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি (নূর) সাধ্য ও সাধ্যের বাইরেও বাঙালীর চিরন্তন সংস্কৃতি ধরে রাখতে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছেন। ওই পর্বে আসাদুজ্জামান নূর সৈয়দ শামসুল হকের ‘নুরল দিনের সারা জীবন’ নাটকের অংশ বিশেষের সঙ্গে হৃদয় কেড়ে নেয়া সেই সংলাপ ‘.......জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই’ বললে দর্শক শ্রোতাদেরও মনে আসে, অপসংস্কৃতি রোধে বাঙালীকে এভাবেই জেগে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হবে ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই....।’
×