ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ লাল গোলাপ ও প্রজাপতি

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৬ অক্টোবর ২০১৮

গল্প ॥ লাল গোলাপ ও প্রজাপতি

হলুদ প্রজাপতিটা কয়েকদিন ধরেই অপেক্ষা করছিল আজকের দিনটার জন্য। আজকের দিনটা মানে লাল গোলাপের ফোটার দিন। লাল গোলাপ গাছটার সঙ্গে তার ভীষণ বন্ধুত্ব। যেদিনই সে প্রথম কুঁড়ি দেখল লাল গোলাপের ডালে, সেদিন থেকেই সে অধীর আগ্রহে বসে আছে ফুল ফোটার অপেক্ষায়। কুঁড়ির ভেতর থেকে একটু একটু করে পাপড়িগুলো চোখ মেলছে। লাল গোলাপ গাছটা আনন্দে চিৎকার করে উঠে প্রজাপতিকে বলল, দেখ সই! ফুলটা ফুটছে! প্রজাপতিটা আনন্দে লাল গোলাপ গাছটাকে ঘিরে কয়েকটা চক্কর দিল। বলল, হ্যাঁ সই! আর কেউ তোমাকে কথা শোনাতে পারবে না। ফুলের রানী আজ তোমার ঘরে! কথা তাকে কেউ শোনাতোও না তেমন। এই বাগানের গাছগুলো সবাই খুব ভাল। কথা শোনানোর মধ্যে ছিল বাগানের মালীটা। প্রতিদিন পানি দিতে এসেই বকবক শুরু করত, কী এক আগাছা পুষছি বসে! দেড় বছর হয়ে গেল লাগিয়েছি, আজ অবধি একটা ফুলও ফুটল না! লাল গোলাপ গাছটাকে মালীটা পানি দিত খুব অবহেলায়। দিতে হবে তাই দেয়া যেন। গাছটাকে সে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু এ বাড়ির ছোট মেয়েটা তা করতেই দেবে না। নিজে হাতে নার্সারি থেকে কিনে এনেছিল বলে এই লাল গোলাপ গাছটার জন্য তার অন্যরকম মায়া। ফুল ফুটুক বা না ফুটুক, গাছটাকে সে উপড়ে ফেলতে দেবে না। মালী অবশ্য বলেছিল, সে নতুন আরেকটা লাল গোলাপের চারা এনে লাগিয়ে দেবে। কিন্তু মেয়েটা রাজি হয়নি। গাছটার মনেও দুঃখ ছিল খুব। এ বাগানে যখন সে প্রথম আসে, তখন তার ভারি অহঙ্কার ছিল। যত যাই হোক, সে হলো লাল গোলাপ গাছ! তার ডালে ফুটে থাকবে টুকটুকে লাল সুগন্ধি গোলাপ। সেই গোলাপ ভালবাসার প্রতীক, সেই গোলাপের কাছে এসে এক হয়ে যায় পৃথিবীর সব ভাষা। কিন্তু গোলাপ না ফোটায় গাছটার মন দিন দিন ভেঙে যাচ্ছিল। আর তখন তার পাশে যে ছিল, সে হলো এই হলুদ প্রজাপতিটা। প্রজাপতিটার কাজ ফুলে ফুলে গিয়ে মধু সংগ্রহ করা। কিন্তু গোলাপ গাছটার দুঃখ দেখে তার খুব মন খারাপ হতো। আর তাই গোলাপ ফুল না থাকলেও প্রজাপতিটা রোজ গোলাপ গাছের ডালে এসে বসত, তার সঙ্গে গল্প করত। এভাবেই গাছটার সঙ্গে তার দারুণ বন্ধুত্ব হয়েছে। প্রজাপতি আর গোলাপ গাছ দুজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে ফুটন্ত ফুলটার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই সঙ্গে তাকিয়ে ছিল পুরো বাগানের বাকি গাছগুলোও। রেইন লিলি তার চিকন পাতাগুলো দোলাতে দোলাতে বলল, কী সুন্দর! কী সুন্দর! অভিনন্দন গোলাপ গাছ! তোমার এতদিনের ইচ্ছে, স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ঝুমকো জবাটা দোল খেতে খেতে বলল, মালী আর তোমাকে কথা শোনাতে পারবে না। ধীরে ধীরে ফুলটা ফুটল। ওহ! কী সুন্দর ফুলটা! যেমন টকটকে লাল, তেমন তার সুগন্ধ। একবার তাকালে আর চোখই ফেরানো যায় না! প্রজাপতিটা খুশি হয়ে বলল, এবার আমি তোমার ফুল থেকে মধু নিতে পারব! আর গোলাপ ফুলের মধু আমার ভীষণ প্রিয়। কথাটা শুনেই গোলাপ গাছ চেঁচিয়ে উঠে বলল, মধু নিতে পারবে মানে? তুমি আমার ফুল থেকে মধু নেবে না! আমার এত কষ্টে ফোটানো এত সুন্দর ফুলটা থেকে তুমি মধু নিয়ে যাবে মানে? প্রজাপতি অবাক হয়ে বলল, সব ফুলের মধুই তো আমরা খাই। এটাই তো আমাদের খাবার। আর মধু খেলে তো ফুলদের কোন ক্ষতি হয় না। তারা বরং আরো সুস্থ থাকে। গোলাপ গাছ রেগে গিয়ে বলল, না। তুমি আমার ফুল ছোঁবে না। আমার ফুলে বসবে না তুমি। আমার গায়েও বসবে না। চলে যাও তুমি। তোমার সঙ্গে আমার কোন বন্ধুত্ব নেই আজ থেকে। প্রজাপতির খুব মন খারাপ হল। সে তবুও গোলাপ গাছকে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু গাছটা বুঝতেই পারল না। শেষে প্রজাপতি মন খারাপ করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর গাছে পানি দিতে মালী এলো বাগানে। গোলাপ গাছটা এই সময়টার অপেক্ষাতেই ছিল। মালীটা তাকে এত অপছন্দ করে যে তার কুঁড়িটাও খেয়াল করেনি এতদিনে। আজকে যখন আচমকা ফুলটা দেখতে পাবে, মালীর প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা দেখার জন্য গোলাপ গাছ মুখিয়ে ছিল। গোলাপ গাছের কাছে আসতেই উজ্জ্বল লাল ফুলটা মালীর চোখে পড়ল। সে মুগ্ধতা নিয়ে বলল, আরে! কী সুন্দর একটা ফুল ফুটেছে গোলাপ গাছটায়! গোলাপ গাছের গর্বে বুক ফুলে উঠল। মালী আপনমনে বলল, ছোট মামনি কতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে এই গাছটার ফুলের জন্য। সে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। র আজ সন্ধ্যায় তো তার বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে। সে খুব সুন্দর করে সাজবে। তার সাজের সঙ্গে এই টুকটুকে লাল গোলাপটা দারুণ মানাবে! কথাটা বলেই গোলাপ গাছের ডাল থেকে লাল গোলাপটাকে ছিঁড়ে নিল সে। গোলাপ গাছ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল, কষ্টে চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। কিন্তু তার কষ্ট দেখে কেউ তাকে সান্ত¡না দিতে এগিয়ে এল না। সবাই তার উপর ছিল খুবই বিরক্ত। বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। গোলাপ গাছটা খুব একা হয়ে পড়েছিল। তার ব্যবহারে সবাই খুব বিরক্ত ছিল। কেউ তার সঙ্গে কথা বলত না। প্রজাপতিটাও এসে অন্য গাছদের সঙ্গে গল্প করত, খেলত, কিন্তু তার কাছে আসত না। গোলাপ গাছটা একা একা পড়ে ছিল বাগানের কোণায়। দিন দিন তার মন আরও ভেঙ্গে যাচ্ছিল, ভেঙ্গে যাচ্ছিল শরীরও। একদিন হলুদ প্রজাপতিটা যখন বেলি ফুলের উপর বসে ছিল, গোলাপ গাছটা করুণ স্বরে তাকে ডেকে বলল, আমার ভুল হয়েছে বন্ধু। আমাকে মাফ করে দাও। আমার সেদিন অহঙ্কারে অন্ধ হওয়া উচিত হয়নি। আমাকে এভাবে একা করে দিও না। প্রজাপতিটা বলল, সেদিন তুমি আমার সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করেছ। কোন বন্ধু আরেক বন্ধুর সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারে না। তুমি তোমার ফুল নিয়ে এতই অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলে যে আমাদেরকে ভুলেই গিয়েছিলে। গোলাপ গাছটা বলল, তার শাস্তি তো আমি পেয়েছি, বন্ধু। আর আমি এটাও বুঝতে পেরেছি, বেশি অহঙ্কারের ফল কখনো ভাল হয় না। তা শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে। প্রজাপতিটা বলল, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম। এখন থেকে আমরা আবার বন্ধু। কথাটা বলে সে গোলাপ গাছের একটা ডালে উড়ে এসে বসল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠে বলল, আরে দেখ দেখ! একটা কুঁড়ি বেরুচ্ছে! গোলাপ গাছটা ডালটার দিকে তাকাল। তারপর সেও আনন্দে চিৎকার করে উঠল। এরপর প্রজাপতিকে বলল, সবার ফুলের মধু খাও তুমি, এবার এই ফুলটার মধু খেতে আসবে কিন্তু! অলঙ্করণ : প্রসুন হালদার
×