ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মদিনে শুভেচ্ছার সাগরে ভাসলেন মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৬ অক্টোবর ২০১৮

  জন্মদিনে শুভেচ্ছার সাগরে ভাসলেন মাশরাফি

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ মাশরাফি বিন মর্তুজা। নামটি একটি অনুপ্রেরণার নাম। সেই মাশরাফির জন্মদিন ছিল ৫ অক্টোবর, শুক্রবার। ৩৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৩৬ বছরে পা দিয়েছেন তিনি। দিনটিতে শুভেচ্ছার সাগরে ভাসেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’। ‘লিজেন্ড’ মাশরাফিকে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ক্রিকেটাররাও। দেশের মানুষের ভালবাসা তো মাশরাফির প্রতি আছেই। বারবার ইনজুরিতে পড়েছেন। কিন্তু প্রতিবার ফিরে এসেছেন আরও বেশি উজ্জীবিত হয়ে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের রূপরেখাই পাল্টে দিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি মাশরাফি। এই ক্রিকেট যোদ্ধার জন্মদিনে আইসিসি শুভেচ্ছা দিয়ে লেখে, ‘অধিনায়ক, নেতা, কিংবদন্তি। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। সম্পতি তিনি বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে সর্বপ্রথম ২৫০ উইকেট নেন এবং তিনিই বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। শুভ জন্মদিন মাশরাফি বিন মর্তুজা।’ মাশরাফি নামের পরশ পাথরের ছোঁয়ায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ম্যাচের পর ম্যাচ, সিরিজের পর সিরিজ লাল-সবুজের দেশকে জিতিয়ে চলেছেন তিনি। ১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে জন্মেছিলেন এই তারকা ক্রিকেটার। কাকতালীয়ভাবে ছেলে সাহেলেরও জন্ম একইদিনে। ২০১৪ সালে ঢাকায় জন্ম হয় মাশরাফি-সুমির প্রথম পুত্রের। তবে মাশরাফি বিন মর্তুজা জন্মদিনের মতো উপলক্ষ উদযাপনে অনাগ্রহী। কারণটাও অবশ্য খোলাসা করেছেন। প্রথম জন্মদিনের সময় ছিলেন নানাবাড়িতে। ওই সময় ধুমধাম করে দিনটি উদযাপন করেছিলেন তার মা, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর নানা মাকে ডেকে বললেন, ‘ধরো তোমার ছেলে যদি ৭০ বছর বাঁচে তাহলে ওর বয়স কমছে না বাড়ছে? মা মাথা নিচু করে বললেন ‘কমছে’। নানা তখন বললেন, ‘তাহলে এভাবে উৎসব না করে গরিব-দুঃখীদের খাওয়াতে পার, নফল নামাজ পড়তে পার।’ এরপর পরিবার থেকে আর কখনও মাশরাফির জন্মদিন পালন করা হয়নি। বড় হয়ে মাশরাফিও আর মায়ের ভাবনার বিপরীতে যাননি। তবে মাশরাফি তার জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা এড়িয়ে গেলেও অন্যরা তো চুপ করে থাকেন না। এইদিনে তাই জন্মদিনের রাশি রাশি শুভেচ্ছায় কেটে যায় মাশরাফির দিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাকে শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন ভক্ত ও সতীর্থরা। বাংলাদেশ অধিনায়কের জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতীয় দলের সতীর্থরা। নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে মুশফিকুর রহীম লিখেছেন, ‘তিনি (মাশরাফি) অনুপ্রেরণার আরেক নাম, শুভ জন্মদিন ম্যাশ।’ মাশরাফির সঙ্গে ছবি পোস্ট করে রুবেল লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন মিস্টার ক্যাপ্টেন, অনেক অনেক দোয়া আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য।’ মাশরাফির জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাসকিন আহমেদও। তিনি লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন ক্যাপ্টেন।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফি। পুরো দলের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। ছোট-বড় মিলিয়ে মাশরাফির এখন পর্যন্ত ১১টি অস্ত্রোপচার হয়েছে হাঁটুতে। এরপরও মাশরাফি খেলে চলেছেন। দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বেই ক্রিকেটে নতুন দিনের পথ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে প্রায় ১৭ বছর ধরে যুক্ত আছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুতে পেসার হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়ালেও বর্তমানে অধিনায়ক হিসেবে তার খ্যাতিটা বেশি। মাশরাফির চোখের পানিতে কেটেছে রাতের পর রাত। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও পরদিন নতুন উদ্যমে ছুটেছেন তিনি। পা হড়কাতে সময় লাগেনি মোটেও তবুও ক্ষান্ত হননি। ভাগ্যকে হার মানার এ লড়াইয়ে শরীরে একের পর এক অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। একটা সময় ডাক্তার তো বলেই দিয়েছেন, হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের জায়গা নেই। হতোদ্যম হননি বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। নিত্যদিন নিজেকে ফিট রাখার লড়াই চালিয়ে গেছেন। একটা সময় নিজেকে দেশসেরার অবস্থান থেকে নিয়ে গেছেন। নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। পরিবারের বড় ছেলেটিকে কিছুতেই ঘরে ধরে রাখতে পারেন না বাবা গোলাম মর্তুজা স্বপন ও মা হামিদা বেগম। সারাক্ষণ দস্যিপনায় মেতে থাকাটাকে নিজের একমাত্র কাজ বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পাড়ার মাঠে ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন ছিল মাশরাফির প্রিয় খেলা। সময় পেলে মেতে ওঠেন ফুটবল নিয়ে। যে কোন খেলায় তার চেয়ে ভাল আর কেউ ছিল না। সমবয়সী তো বটেই, ম্যাশের সঙ্গে বড়রাও পেরে উঠতেন না। পাড়ায় খেলে বেড়ানো ছেলেটি মাত্র ১১ বছর বয়সেই নড়াইল ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৯১ সালে মাগুরা হয়ে বিকেএসপির ক্যাম্প। সেখানে যোগ দিয়ে নিজের বোলিং শক্তি প্রদর্শন করেন ম্যাশ। এরপরই নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে তার। বিকেএসপির কোচ বাপ্পি তাকে অনেকগুলো বিষয় শিখিয়ে দেন। পরের বছর নড়াইলে এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অসাধারণ পারফর্ম করার পর জায়গা পেয়ে যান খুলনা বিভাগীয় অনুর্ধ-১৭ দলে। এরপর আর কখনও পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ দলে ডাক পেয়ে যান মাশরাফি। এর পরই বদলে যায় তার জীবন। ক্যারিবীয় কিংবদন্তি এ্যান্ডি রবার্টস বদলে দেন তার সবকিছু। রবার্টস বলেছিলেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে একদিন সেরা বোলারে পরিণত হবেন মাশরাফি। অনুর্ধ-১৭ ও ১৯ দলে মাশরাফির ব্যাটিং ও বোলিং দেখে তাকে জাতীয় দলে ভেড়াতে খুব একটা সময় নেননি নির্বাচকরা। ২০০১ সালের ৮ নবেম্বর জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে নেন ৪ উইকেট। বৃষ্টিবিঘিœত ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে বল করার সুযোগ পাননি। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও জায়গা পেয়ে যান। ফাহিম মুনতাসির ও তুষার ইমরানের সঙ্গে অভিষেক হয় তার। প্রথম ম্যাচেই গতি আর বাউন্স দিয়ে এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারদের মতো ব্যাটসম্যানকে অতিষ্ঠ করে তোলেন। সেই ম্যাচে এ দুই ব্যাটসম্যানকে ফেরান মাশরাফি। অভিষেকের পরই কঠিন জীবন শুরু হয় মাশরাফির। ২০০২ সালে প্রথম ইনজুরিতে পড়েন। গাছে উঠেছিলেন, পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়ে অপারেশন করাতে যেতে হয় চেন্নাইতে। সেবার তাকে ১৪ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয়। প্রথমবারের মতো লিগামেন্ট ছিড়ে যায়। পরের বছর আবার ইনজুরি। এবার ছিড়ে ডান পায়ের লিগামেন্ট। অপারেশন করতে গিয়ে অর্থোপেডিক সার্জন ডেভিড ইয়াং টের পান যে আগেরবার বাঁ পায়ের অপারেশনটা ঠিকমতো হয়নি। ফলে এক মাসের ব্যবধানে দুই পায়েই অপারেশন করতে হয় তাকে। সেবার ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন নয় মাস। ইনজুরিকে সঙ্গে নিয়ে ক্যারিয়ারে এগিয়ে গেছেন মাশরাফি। এই সময়ের অর্ধেকটাই মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাকে। ইনজুরির কারণে ঘরের মাঠে ২০১১ সালের বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। ব্যথানাশক ওষুধ আর ইনজেকশনকে এখন বানিয়ে ফেলেছেন জীবনেরই অনুষঙ্গ। খেলা চলার সময় হাঁটু ফুলে যায় তার। তখন ইনজেকশন দিয়ে ব্যথা নিবারণ করতে হয়। এছাড়া হাঁটু থেকে ইনজেকশনের সাহায্যে পুঁজও বের করতে হয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। মাত্র ৪৭ ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে টাইগারদের ২৭টি ওয়ানডে ম্যাচে জিতিয়েছেন তিনি। সংখ্যার দিক থেকে ম্যাশের চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল হাবিবুল বাশার। ৬৯ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে ২৯ বার জেতান সাবেক এই অধিনায়ক। মাশরাফির নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা-ভারত-পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলগুলোকে সিরিজ হারায় টাইগাররা। একটানা ছয়টি সিরিজ জেতে লাল-সবুজের দল। এছাড়া তার অধীনেই ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলে বাংলাদেশ। এবার এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলল বাংলাদেশ। অধিনায়ক হিসেবে দেশের আর কোন অধিনায়কেরই এত বেশি সফলতা নেই। এ জন্যই মাশরাফিকে টাইগার অধিনায়কদের অধিনায়ক বলা হয়। ক্যারিয়ারের ৩৬ টেস্ট খেলে ৭৮ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৭৯৭ রান করেছেন তিনি। ১৭৯টি ওয়ানডে ম্যাচে নিয়েছেন ২৩২ উইকেট। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের মাশরাফির চেয়ে বেশি উইকেট নেই আর কারোরই। ব্যাট হাতে করেছেন দেড় হাজারেরও বেশি রান। দেশের জন্য সব আত্মত্যাগ করতে পারেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্ধকারের আলোর দিশারী তিনি। একটি অনুপ্রেরণার নাম। সেই মাশরাফির জন্মদিনে শুভেচ্ছা মিলবে না, তা কি হয়। শুভেচ্ছার সাগরেই ভাসেন মাশরাফি।
×