ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাদিয়া মুরাদ- হার না মানা এক ইয়াজিদী নারীর উপাখ্যান

প্রকাশিত: ০৫:০০, ৬ অক্টোবর ২০১৮

 নাদিয়া মুরাদ- হার না মানা এক ইয়াজিদী নারীর উপাখ্যান

বিডিনিউজ ॥ চার বছর পর আবারও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন একজন নারী। পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের পর ইয়াজিদী নারী নাদিয়া মুরাদ, দুজনই জঙ্গী হামলার প্রত্যক্ষ শিকার। নারীদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ২০১৪ সালের অক্টোবরে মালালা যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, ঠিক তার দুই মাস আগে ইরাকের পাহাড়ি অঞ্চল সিনজারের একটি ইয়াজিদী গ্রামে হামলা চালিয়ে নাদিয়া মুরাদকে ধরে নিয়ে যায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গীরা। ২০১৪ সালের অগাস্টে আইএস জঙ্গীরা সিনজার দখল করে। নাদিয়া মুরাদ তখন ২১ বছরের তরুণী। আইএস জঙ্গীরা নাদিয়াদের গ্রাম কোচোতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। তারা গ্রামের প্রায় সব পুরুষ ও বয়স্ক নারীদের হত্যা করে। যাদের মধ্যে নাদিয়ার ছয় ভাই এবং তার মাও ছিলেন। জঙ্গীরা গ্রামের অন্য ইয়াজিদী নারীদের সঙ্গে নাদিয়াকেও ধরে নিয়ে যায় এবং যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেয়। নানা হাত ঘুরে একসময় মসুল পৌঁছে যান নাদিয়া। এই সময়ে তাকে আইএস জঙ্গীরা অসংখ্যবার ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন করে। মসুল তখন আইএস ঘোষিত ইসলামিক খেলাফতের ইরাক অংশের রাজধানী। নাদিয়া তিন মাস আইএসের হাতে বন্দী ছিলেন। ওই সময়ে যৌনদাসী হিসেবে কয়েকবার তাকে বিক্রি করা হয়। প্রথমবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান নাদিয়া। এতে বাড়ে নির্যাতনের মাত্রা। মসুলে তাকে আবারও বিক্রির প্রস্তুতি চলছিল। একদিন সুযোগ বুঝে আইএস বন্দীদশা থেকে পালিয়ে এক সুন্নি মুসলিম পরিবারে আশ্রয় নেন নাদিয়া। ওই পরিবার তাকে মসুল থেকে পালিয়ে আসতে সব রকম সহায়তা করে বলে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জানান নাদিয়া। নিউইয়র্ক টাইমসে নাদিয়াকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, নাসির নামে এক সুন্নি মুসলমান নাদিয়াকে স্ত্রীর পরিচয়ে আইএসের চোখে ধুলা দিয়ে মসুল সীমান্ত পার করে দেন। আইএসের হাতে তিন মাস বন্দী ছিলেন নাদিয়া। নিজের জীবনের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীকে জানাতে ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ নামে একটি বই লেখেন নাদিয়া, যা ২০১৭ সালে প্রকাশ পায়। ওই বইতে তিনি লেখেন, ‘কখনও কখনও ধর্ষিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই সেখানে ঘটত না। একসময় এটা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যায়।’ জার্মানির একটি শরণার্থী প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালে আরও এক হাজার নারী ও শিশুর সঙ্গে জার্মানি পাড়ি জমান নাদিয়া। বর্তমানে সেখানেই তিনি বসবাস করছেন। ওই বছর ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আইএসের হাতে নিপীড়নের ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন নাদিয়া। তারপর থেকেই তিনি ইয়াজিদী জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি মানবাধিকার এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের ব্যবহারের বিরুদ্ধেও কাজ শুরু করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ‘নাদিয়াস ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আইএসের বিরুদ্ধে ইয়াজিদী জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনেন। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আইনজীবী আমাল ক্লুনি তার ও ইয়াজিদী জনগোষ্ঠীর হয়ে মামলা লড়ার ঘোষণা দেন। নাদিয়াকে যখন আইএস ধরে নিয়ে যায় তখন তিনি স্কুলে পড়তেন। তার স্বপ্ন ছিল ‘বিউটি পার্লার’ খোলার। আইএস সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি ইয়াজিদীকে হত্যা করে। ধরে নিয়ে যায় আরও অন্তত তিন হাজার ইয়াজিদী নারীকে, যাদের মধ্যে আট বছরের শিশুও ছিল। আন্তর্জাতিকভাবে ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের মুক্তি এবং মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রচারের প্রতীকে পরিণত হওয়া নাদিয়া ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইউরোপীয় কাউন্সিলের ‘ভ্যাকলাভ হ্যাভেল’ মানবাধিকার পুরস্কার জয় করেন।
×