ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ৬ অক্টোবর ২০১৮

 মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গত ৩ অক্টোবরের পর) সংক্ষেপে মোটামুটিভাবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বলতে কি বোঝায় সেটা উনাকে বলা হলো এবং বিগত মাসগুলোতে আমরা কি কি কাজ করেছি এবং ভবিষ্যতে আমরা কি কি কাজ করতে যাচ্ছি তার একটা বিবরণ পেশ করা হলো। তবে উনি বার বার যেভাবে আমাদের জন্য দুপুরের খাবার আনার কথা বলছিলেন তাতে আমার মনে হলো মন্ত্রী মহোদয় সম্ভবত খুব অতিথিপরায়ণ ও দরাজ দলের লোক।’ আমার কথাগুলো শুনে মন্ত্রী মহোদয় খুব খুশি হলেন। তিনি সচিব মহোদয়কে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাজ আরও বেশি করে এবং আরও ব্যাপকভাবে চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলেন, যাতে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের শত অত্যাচার এবং অমানবিক তৎপরতা সত্ত্বেও দেশের মানুষের মনোবল শক্ত থাকে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে এগিয়ে আসে ও একতাবদ্ধ হয়ে দৃঢ়ভাবে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন যে, সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক এই ধরনের তৎপরতা আরও বেশি জোরালোভাবে ভবিষ্যতে চালিয়ে গেলে বিশ্ব জনমত আরও বেশি সক্রিয়ভাবে আমাদের পক্ষে আসবে ফলে পাকিস্তান ও তাদের সমর্থনকারী মাত্র গুটিকয়েক দেশ ও তত বেশি সোচ্চার হতে সক্ষম হতে পারবে না আমাদের বিপক্ষে। এ সময় তিনি সচিব মহোদয়ের কাছে জানতে চাইলেন যে আমাদের দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাবার জন্য কোন অসুবিধা আছে কিনা এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সহায়তা করার জন্য তার করণীয় কিছু আছে কিনা। আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কাজে সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়ার জন্য সচিব সাহেব মন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং জানতে চান এ বিষয়ক কাজ আরও বেশি কার্যকর ও জোরদার করার জন্য তার কোন পরামর্শ ও প্রস্তাব আছে কিনা। মন্ত্রী মহোদয় বললেন মুজিবনগরে আওয়ামী লীগের অস্থায়ী অফিসে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগ ও মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ওই সময়ে সহযোগিতা প্রদানকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও শীর্ষস্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশের ভেতরের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে যা মূল্যায়ন করে আমাদের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। কামরুজ্জামান সাহেব আমাদের আরও যাদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের পরামর্শ ও সুপারিশ নেয়ার পরামর্শ দিলেন তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানী, স্টাফ প্রধান লে. কর্নেল এমএ রব, ডেপুটি স্টাফ প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার ও সেক্টর কমান্ডাররা। তিনি খুব খুশি হলেন এটা জেনে যে, ইতোমধ্যে আমরা এদের অধিকাংশের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছি এবং পরামর্শও নিয়েছি কিভাবে আমরা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার কার্যক্রম আরও বেশি কার্যকরীও জোরদার করতে পারি। তাকে আমরা এও জানিয়েছি যে চীফ অব স্টাফ লে. কর্র্নেল এমএ রব তখন আগরতলায় একটা আঞ্চলিক অফিসের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তাই তার সঙ্গে আমাদের পক্ষে আলাপ-আলোচনা করা সম্ভবপর হয়নি। মন্ত্রী মহোদয় বললেন যে, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে কি পটভূমিকায় এবং কি পরিস্থিতিতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারলে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের তৎকালীন সামরিক ও বেসামরিক রাষ্ট্রনায়কদের প্রতিনিধিত্বকারী সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকার পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ জনগণ ও তাদের নির্বাচিত নেতা এবং দলীয় কর্মীদের ওপর অতর্কিতভাবে ট্যাঙ্ক, কামান ও অন্যান্য সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হানাদার পাকবাহিনীর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও নগ্ন অভিপ্রায়ের প্রকৃত চিত্র দিবলোকের মতো সুস্পষ্টভাবে পরিষ্কার হয়ে যাবে যা আমরা ইতোমধ্যে অনেকটা করতে সমর্থ হয়েছি। আর একটু জোরালোভাবে এবং সংগঠিতভাবে বিষয়টা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারলে বিশ্ব জনমত পরিপূর্ণভাবে আমাদের স্বপক্ষে কার্যকরী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে বলে মন্ত্রী কামরুজ্জামান আমাদের বললেন। তিনি আমাদের অবহিত করলেন যে, বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত পাক সেনাদের সংখ্যা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে সেনাবাহিনীতে চাকরিতে কর্মরত লোকের সংখ্যা অধিক সে সমস্ত অঞ্চলে ছোটখাটো বিদ্রোহ ও অশান্তির আগুন জ্বলে উঠতে শুরু হয়েছে। তিনি প্রতিরক্ষা সচিবকে আরও বেশি সংগঠিতভাবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশও দিলেন। সবশেষে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের উল্লেখ করে তিনি আমাদের যে সুখবরটি দিলেন তা হলো যে দেশের ভেতরে বসবাসকারী আমাদের মানুষদের মনোবল এখন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। বিভিন্ন অঞ্চলে এখন হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহায়তাকারী রাজাকার বাহিনীর লোকেরা এখন আর তাদের জ্বালাও পোড়াও-হত্যাযজ্ঞ পরিচালনায় আগের মতো নির্বিঘেœ অপারেশন চালাতে সক্ষম হচ্ছে না। অন্যদিকে রাজাকার বাহিনীর অনেক সদস্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগদান করে তাদের আরও বেশি শক্তিশালী করছে। তবে দেশের মানুষের মনোবল বৃদ্ধিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিশেষ করে এমআর আকতার মুকুল সাহেবের চরমপত্র এবং বিবিসি রেডিও প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের খবর অন্যান্য বিশ্লেষণমূলক আলোচনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×