ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুম বিল্লাহ

আমার বাংলা বই

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ৫ অক্টোবর ২০১৮

আমার বাংলা বই

চিঠিটি একবার নয়, দুবার পড়লেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী আসাদুজ্জামান। তারপর উচ্চকণ্ঠে স্ত্রীকে ডাক দিলেন। রান্নাঘর থেকে পড়িমরি করে ছুটে এলেন আফরোজা সুলতানা। বলেন, সাতসকালে জনাব মুক্তিযুদ্ধের আবার কী হয়েছে? চিঠিটা স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, পড়ো। চিঠি পড়া শেষ করে স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সোজা রান্নাঘরে ফিরে এলেন আফরোজা সুলতানা। মেজাজের মিটার তরতর করে বেড়ে গেল কাজী সাহেবের। চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়ালেন। বুকের শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। স্ত্রীও টের পেলেন স্বামী মহোদয় এখনই মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় নেমে পড়বেন, গর্ব করে বলা শুরু করবেনÑএকজন মুক্তিযোদ্ধাকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা তোমাদের বংশের কেউ জানে না কি। সরকার ঠিকই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ফিরিয়ে দিচ্ছে, দেখো। স্বামী কথা বলার আগেই আফরোজা সুলতানা বলেন, খুবই খুশির খবর, স্কুলের বাচ্চাদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকে অতিথি করে সম্মান জানাবে, এটা তো বিরাট ব্যাপার। কাজী সাহেব এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করতে দিও।- কথা শেষ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। পেছনে স্ত্রীর চাপা হাসি দেখতে পেলেন না তিনি। হাতে আর দুই দিন। ভেতরে তর সইছে না। মনের চোখ দিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তিনি নতুন বই তুলে দিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুবই গর্বিত বোধ করছেন। এই দুটো দিন বেশ ফুরফুরে মেজাজে কাটালেন। অনুষ্ঠানের দিন খুব ভোরে বিছানা ছাড়লেন। ইস্ত্রি করা জামাকাপড় পড়ে নিজেকে পরিপাটি করলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন বেশ কিছু সময়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। সকালের নাস্তা পুরোটা শেষ না করেই বাসা থেকে বের হওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন। স্ত্রী আফরোজা সুলতানা স্বামীকে বললেন, অনুষ্ঠান তো সকাল ১০টার আগে শুরু হবে না। মুক্তিযুদ্ধ এতো তাড়াতাড়ি যাচ্ছে যে? তুমি একবারও ভেবে দেখেছো, একজন মুক্তিযোদ্ধা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের হাতে নতুন বই তুলে দেবে? স্ত্রী বললেন, এটা আর কতবার বুঝব মুক্তিযুদ্ধ? আফরোজা সুলতানা সুযোগ পেলেই স্বামীকে মুক্তিযুদ্ধ বলে ডাকার চেষ্টা করেন। কাজী সাহেবও কখনো কখনো রাগ করেন, আবার কখনো খুশি হন। আজ আর স্ত্রীকে কিছু বললেন না, খুশি মন নিয়ে স্কুলের পথে রওয়ানা হলেন। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো ঘণ্টা দুই বাকি। স্কুলের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন। দেখলেন স্কুলের ছেলে-মেয়েরাও তার মতো আগেভাগে যাচ্ছে। খুশি হলেন তিনি। এ সময় একজন ভ্যানঅলা তার পাশে এসে থামল। ভ্যানঅলা বলল, আরে চাচা, আপনে হাইট্টা যাইতাছেন ক্যান? আসেন ভ্যানে যাইবেন। তিনি রাজী হলেন না। কিন্তু ভ্যানঅলা তাকে প্রায় জোর করেই ভ্যানের সামনে বসাল। ভ্যান থেকে নেমে জোর করে ভাড়া দিলেন তিনি। স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার মুখে কয়েকজন তাকে এত সকালে আসতে দেখে অবাক হলো। তিনি হাসি মুখে তাদের এড়িয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকে দেখেন ছোটখাটো একটা মঞ্চের মতো করে বানানো হয়েছে। তার সামনে সারিবদ্ধ প্ল্যাস্টিকের চেয়ার। পুরো মঞ্চ ফাঁকা। গুটি কয়েক ছাত্র-ছাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে ব্যস্ত। কাজী সাহেব ওদের এক পাশে গিয়ে বসলেন। দ্রুত পায়ে একজন লোক ছুটে এল। তারপর বলল, স্যার আপনে হেডস্যারের রুমে এসে বসুন। তিনি মাথা নেড়ে না করলেন। বলেন, আমি এখানেই বসি। অনুষ্ঠানের সময় যখন আমাকে দরকার হবে তখনই যাব। পাশের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি করে কথা বলছে। কিছু কিছু কথা কাজী সাহেবের কানে আসতে লাগল। ওদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন বই কখন দেবে সে চিন্তার অস্থির। কাজী সাহেবেরও ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। কিছু সময় পর তার পেছনের চেয়ারে বসা দুটি মেয়ের কথোপকথন কানে ভেসে এল। প্রথম মেয়েটি খুবই মন খারাপের সুরে বলছে, জানিস তুলি, ইয়ে হ্যায় মহব্বতী সিরিয়ালটা গতকাল দেখতে পারিনি। তুলি মেয়েটাও দ্বিগুন অবাককণ্ঠে বলল, কেন কেন দেখিসনি? বড়খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রথম মেয়েটি বলে। তোর বড়খালার বাসায় ডিশলাইন নাই? না রে। আবারো একরাশ হতাশামাখা কণ্ঠে বলল মেয়েটি। তাহলে আজও তো পুনঃপ্রচার দেখতে পাবি না। বই দেওয়া কখন শেষ হবে কে জানে! এই পর্বে রামান ভাল্লা আর ঈশিতা ভাল্লার মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে একটু বল? কাজী সাহেব ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন আবারও মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে ফিরে যাবেন। বুক ভরে গৌরব অনুভব করবেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বটা তুলে ধরবেন, কিন্তু আজ আনন্দ অশ্রুর বদলে বেদনার অশ্রুতে ভাসতে হবে তিনি কখনোই কল্পনা করেননি। শরীরে শার্ট ঘামে ভিজে উঠেছে ইতিমধ্যে। তিনি সময় বোঝার চেষ্টা করলেন, কিন্তু হাতে ঘড়ি না থাকার কারণে বুঝতে পারছেন না। অনুষ্ঠানের মঞ্চের চেয়ার একে একে পূর্ণ হতে দেখলেন তিনি। তার কিছু সময় পরই কাজী সাহেবের খোঁজ পড়ল। ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। বই তুলে দেয়ার আগে তাকে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করার জন্য ঘোষণা করা হলোÑ আর্দ্রস্বরে তিনি শুধু বললেন, বুকের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষা পেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ, কিন্তু ঘরে ঘরে টিভিতে ভিনদেশি ভাষার সিরিয়াল দেখে ছোট ছোট বাচ্চারাও বাংলাকে, বাংলার সংস্কৃতিকে ভুলে যাবে...এই জন্যই কী ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, স্বাধীন দেশের জন্য, পতাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি...এই হাত দিয়ে ‘আমার বাংলা বই’.কেমন করে তুুলে দেই...
×