ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একগুচ্ছ গল্প ॥ কলম-কথা

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ৫ অক্টোবর ২০১৮

একগুচ্ছ গল্প ॥ কলম-কথা

কবিতা উৎসবে গিয়ে অনিরুদ্ধ সোম দেখে ও একা হাতে লেখে না। লেখে আরও অনেকে। অনেকেই ওকে বলেÑ এত আধুনিক তুমি। কম্পিউটার ব্যবহার কর না। অবশ্যই করি। তবে লেখালেখি হাতে। মনের ভাব মন থেকে হাতে যায়। কলম সেই ভাব লেখে। কম্পিউটার আমার কাছে যন্ত্র মনে হয়। তবে একজন সেক্রেটারি জাতীয় লোক আছেন যিনি দরকার মতো আমার লেখা কম্পোজ করে দেন। সেক্রেটারি জাতীয়? না সেক্রেটারি? অনিরুদ্ধ সোম বলেন নাÑ আসলে সেই সেক্রেটারি আর কেউ নয় তাঁর স্ত্রী মেরিনা। সংক্ষেপে মেরু। বেশ গেল তিনদিন। এতবড় সম্মেলনে আগে কখনও যাননি অনিরুদ্ধ। পুরো ঢাকা, কলকাতা, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, আগরতলা, বটতলা সবখান থেকে গনগনে লোকজন এসেছে আসরে। আলমগীর হাসানের কবিতা বেশ লাগে তার। কবিতাগুলো প্রেমের, বিষাদের, বেদনা, আনন্দ ও সুখের কবিতা। তবে সবখানেই একটা সরু বেদনার তার কোন এক আশ্চর্য অনানুকরণীয় সুর তোলে। তোমার কাঁধে হাত রাখতেই বৃষ্টি! আসলে সেদিন ঢাকাতে এক ফোঁটা মেঘ ছিল না। এমনি নানা ধরনের অনুভব আর অনুভূতির কবিতা। আমি পালাতে চাই তেজপাতা থেকে দারুচিনি পাতায়, আমি দেখতে পাই মসলার কৌটায় তোমার মুখ। রাজেন্দ্র কলেজ ফরিদপুর! একদিন দুজনে চা পান করতে করতে এমনি সব কবিতা শোনান। আলমগীর হোসেন নোট বই খুলে একটার পর একটা কবিতা বাছেন। চা বিস্কুট মুচমুচে শব্দ/কবিতার সুখ। অনিরুদ্ধ বলেÑ আপনি কি হাতে লেখেন? না হলে কিসে? মেশিনে। নানা সেটা আমার ভাললাগে না। ছয়টা কবিতার বই বেরিয়েছে সবগুলো কলমে। পকেট থেকে কলম বের করেন আলমগীর হোসেন। কালো সাধারণ কলমের উপরে সোনালি নামের আদ্যাক্ষরÑ আ হা। বলেÑ বউ দিয়েছিল এক জন্মদিনে। ওই আ হা লিখেছে কোন একজনকে দিয়ে। কলকাতার কোন এক দোকান থেকে কিনেছিল। পাঁচ বছর হলো লিখছি। এ দিয়েই ছয়টা কবিতার বই বেরিয়েছে। দেদার কবিতা লিখছি। কালি ভরে লেখা যে চল সেটা প্রমাণ করতে। আবার বাইরোর মতো ব্যবহার করাও যায়। কলমটা না জীবন্ত। বাবার কাছ থেকে একটা পার্কার পেন পেয়েছিলাম কালি ভরে লেখা যায়। এখন এইটা। তবে আমি বাইরোর মতো ব্যবহার করি। অনিরুদ্ধ সোম বলেন- ¯œ্যাাপ। আমিও তাই করি। তবে কালিভরা কলমে নয় নানা সব বাইরো আছে তা দিয়ে। অনেকেই তাই করে। ভাব মরে যাবার আগে হাতেই লিখে ফেলে। আপনি কি আর কিছু লেখেন? মানে গদ্য? অনিরুদ্ধ প্রশ্ন করেন আলমগীরকে। না। কেবল কবিতা। ওই আমার প্রাণ আমার সবিতা। কলম টাকে চুমু খান আলমগীর। আপনি? প্রধানত গদ্য। হঠাৎ কবিতা। কেমন করে যে আমন্ত্রণ পেলাম বুঝতে পারছি না। একজন কর্তা ব্যক্তি আমার আত্মীয় উনিই ব্যবস্থা করেছেন বুঝতে পারছি। এরপর আরও কয়েক কাপ চা পান করে, বিস্কুট ডানকিং করে ফিরে যায় যে যার আসরে। আসার দিনে হঠাৎ করে অনিরুদ্ধের ছোট গল্পের বই -‘হরিৎ মদ’ বইটা একজন এনে ওনাকে সাইন করতে বলে। যা হয়Ñ পকেটে কোন কলম পান না। আলমগীরকে ওর কলম ধার দিতে বলেন। আলমগীর ওর সেই কালো কলমটা অনিরুদ্ধকে দেয়। যেখানে আছে সোনালি অক্ষরে ওর নামের আদ্যাক্ষর। এরপর কে যেন ওকে ডাকে। এরপর আলমগীর হাসতে হাসতে সেদিকে এগিয়ে যায়। কলমটা রয়ে যায় অনিরুদ্ধের কাছে। আলমগীর এসেছিলেন বালুর ঘাট থেকে। অনিরুদ্ধ ঢাকার। মন খারাপ হয় ওর বউএর সে উপহার- কালো আর সোনালি কলমটা ওর কাছে থেকে গেল বলে। কয়দিন পর মনে মনে ভাবছেন অনিরুদ্ধ সোম একটা গল্প লিখবেন। টেবিলে বসেছেন। লিখতে চাইছেন আলমগীর হাসানের কলম দিয়ে। ওমা! কি ব্যাপার? কেবল তো কবিতার পর কবিতা আসছে। গল্প তো আসে না। বিরক্ত হয়ে যান তিনি। আর কবিতাগুলো সব হয়ে গেছে আলমগীরের কবিতার মতো।- জলবুকে বসে আছে মেঘের নূপুর/আমার একলা দুপুর। তুমি কোথায়/হাত বাড়াই কোন আশায়? রেগে যান অনিরুদ্ধ সোম। এমন কবিতা তিনি লেখেন না। এরপর যা লিখতে চান সব আলমগীর হাসানের কবিতা হয়ে যায়। মানে স্টাইলটা একেবারে একরকম। আলমগীর বলেছিলেন- তিনি ঢাকার ‘শব্দালিতে’ কবিতা পাঠাবেন। যথাসময়ে শব্দালি এলে সেখানে আলমগীরের কবিতা দেখা যায় না। লেখা- ঘোষণা দেয়ার পরও আলমগীর হাসানের শরীর খারাপের জন্য ওর কবিতা ছাপানো গেল না। দুঃখিত। দিব্যি ভাল মানুষ আলমগীর হাসান। তাঁর আবার কি হলো? একটা দুশ্চিন্তা অনিরুদ্ধ সোমকে পেয়ে বসে। কোন এক রেস্টুরেন্টে নোটবুকে কি যেন লিখতে গিয়ে কলমটা সেখানে ফেলে আসেন। ইচ্ছা করে কিনা কে জানে। দুই সপ্তাহ পরে শব্দালিতে কতগুলো কবিতা দেখেন। লেখা মেহেরুন নেসা। এই কবির নাম আগে শোনেননি অনিরুদ্ধ সোম। আশ্চর্য তিনটা কবিতা দিয়েছে মেহেরুন। ঢাকার কবি। মনে হয় সে আলমগীরের ভাবশিষ্য। একই ধরনের কবিতা লিখেছে। সেদিন রেস্টুরেন্টে নীল শাড়ি পরে একজন বসেছিল। সেইকি মেহেরুন। কলমটা ফেলে এসেছিলেন না? এক টুকরো কাগজ আর কলম। অনিরুদ্ধ সোম ফিরে পেয়েছেন গদ্য লেখার ভাষা। নিজের কলমে। মনে মনে বলেনÑ বাঁচলাম। তিন মাস পরে মাস পরে এক কবিতা সমগ্রতে কতগুলো কবিতা দেখেন। লিখেছেন বিপুল রায়ান। সবগুলো কবিতাই আলমগীর হাসানের স্টাইলে লেখা। তাহলে মেহেরুন নেসা কি কলম হারিয়ে ফেলেছিল? অনিরুদ্ধ কিছু বুঝতে পারছেন না। এরপর আরও কয়েকবার আলমগীরের কবিতার মতো কবিতা চোখে পড়েছে। কিন্তু কোনখানে আর আলমগীর হাসানের নিজের লেখা কবিতা দেখেননি। একদিন অনেক খোঁজ করে একটা চিঠি বালুরঘাটে আলমগীর হাসানকে পাঠাবেন বলে ঠিক করেন। এক বছর চলে গেছে। ওর বাড়িটার নাম -ছন্দালি। মনে আছে এ নাম। সেখানকার ঠিকানায় একটা চিঠি লেখেন। কলমের কথা বলেন না। লেখেনÑ আলমগীর হাসান আপনি আর শব্দলিতে লেখেন না কেন? কোন পত্র-পত্রিকায় আপনার কবিতা দেখি না। টসটসে, মুচমুচে, জলজ, সহাস্য, রোদেলা নানা সব কবিতা। আপনি ভাল আছেন তো? খুব তাড়াতাড়ি উত্তর আসে। লেখাÑ প্রিয় অনিরুদ্ধ কেবল আপনি একা নন আরও অনেকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছে কেন আমি আর কবিতা লিখি না। বুঝতে পারছি না কবিতা কেন আমার উপর অভিমান করল? বউ আবার কলকাতা গিয়ে সেই দোকান থেকে একটা পেটমোটা কলম দিয়েছে। ওকে ‘কিমো’ নিতে মাঝে মাঝে কলকাতা যেতে হয়। বলেÑ সেই রহস্যময় দোকানের কলম। লোকটা জিনিস বিক্রি করতে করতে খালি কবিতা লেখে। আমি সেই কলম দিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম এ কলম কবিতা লিখবে না। কেবল ভয়ানক সব জ্ঞানের রচনা। জীবনেও ভাবিনি ‘গ্লোবালাইজেশন’ আমি কিছু লিখতে পারব। ‘থার্ড ইকোনমি ইজ ড্রাগ’ এইসব। এসব ওই পেটমোটা কলমটা আমাকে দিয়ে চলেছে। আমার সেই আ হা লেখা কলমটা কেমন করে যে হারিয়ে গেল বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে লিখবেন। আজকের দিনে কেউ চিঠি লেখে না। যেমন এখন আর কেউ কলম দিয়েও লেখে না। মানুষজন কেমন যন্ত্র হয়ে উঠছে দেখেছেন? বুঝতে পারছি না কবিতা কেন আর আসে না। আলমগীর হাসান স্বস্তি পেলেন অনিরুদ্ধ সোম তিনি যে কলম ধার নিয়েছিলেন উনি তা মনে করতে পারছেন না। কেন কবিতা আসে না? হয়ত অনিরুদ্ধ সোম খুব ভাল করে এর কারণ জানে।
×