ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইব্রাহীম রাসেল

প্রতিবাদের কাণ্ডারী

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৫ অক্টোবর ২০১৮

প্রতিবাদের কাণ্ডারী

কাজী নজরুল ইসলাম বহুমুখী পরিচয়ের অধিকারী। তাঁর প্রধান পরিচয় ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। বিদ্রোহ তিনিই করতে পারেন যার ভেতর প্রতিবাদী চেতনা আছে। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে যিনি প্রতিবাদী চেতনা লালন করেন। সেই অর্থে নজরুলকে বলতে পারি বাংলা সাহিত্যে প্রতিবাদের কা-ারী। যার সূচনা হয়েছে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। প্রতিবাদের পথেই যিনি সদা হেঁটেছেন, শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী চেতনা লালন করেছেন এবং প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার বারুদতুল্য লেখনিতে। সূচনালগ্নে আমরা তাঁর প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখেছি ভারতবর্ষে ইংরেজদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি যেমন প্রতিবাদ করেছেন তেমনি প্রতিবাদ করেছেন লেখনির মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯২০ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস যখন ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক গ্রেফতার হন, নজরুল ইসলাম তাঁর গ্রেফতারের প্রতিবাদে লিখেছিলেন ‘ভাঙার গান’ নামক কবিতাটি- কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট... নজরুলের এই প্রতিবাদী ভূমিকা নিপীড়িত মানুষের মাঝে যেমন চেতনার সঞ্চার করেছিল, তেমনি সাহিত্যবোদ্ধাদের মাঝে তাঁর পরিচয়ের জানান দিয়েছিল। ব্রিটিশ শোষণের প্রতিবাদে নজরুল ইসলামের অগ্নিঝরা প্রতিবাদী চরণ- এদেশ ছাড়বি কিনা বল্ নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল। নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেই তার প্রতিবাদ ক্ষান্ত করেননি। নিজেও অংশগ্রহণ করেছেন সংগ্রামে। যোগ দিয়েছেন সৈনিক দলে। তাকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল প্রতিবাদী উচ্চারণের জন্য। কারাগারে বসে তাঁর লেখা গান আজও তাঁর প্রতিবাদের সাক্ষ্য দেয়- মা, আমি বন্দী কারাগারে... স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নজরুলের কবিতা ও গানে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে বহুবার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- কৈ রে, কৈ রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিক প্রবলের মা’র। নজরুলের ভাষ্য ছিল-আমি স্বরাজ বুঝি না, স্বাধীনতা চাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার আকুতি ছিল প্রবল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন-‘আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন’ নামের কবিতা। যে কবিতায় তিনি বলেছিলেন- ঘুমাইয়াছিল আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন বহু বছর মুখে চেপেছিল পাষাণের আবরণ। ১৯২১ সালে নজরুল ইসলাম রচনা করেন রক্তে দোলা জাগানিয়া প্রতিবাদের উন্মত্ত চেতনায় উদ্ভাসিত করা কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যে কবিতার প্রতিটি চরণ যেন শরীরের রক্ত শুদ্ধ করে আওয়াজ তোলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের দামামা বাজায় প্রতি মুহূর্তে। বল বীর বল, চির উন্নত মম শির শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির। এই কবিতার শেষ দুটি চরণে উচ্চারিত হয়েছে কবির অনলবর্তী উচ্চারণ- মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত। নজরুল ইসলাম নিজে যেমন প্রতিবাদী ছিলেন তেমনি বাঙালী জাতিকে জুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে তুলেছেন তাঁর কবিতার মাধ্যমে। ১৯২৬ সালে রচিত ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা সঞ্চার করতে তিনি লিখেছিলেন ‘নতুনের গান’ নামের কবিতাটি। যে কবিতায় তিনি বলেছেন- উষার দুয়ারে হানি আঘাত আমরা আনিব রাঙা প্রভাত আমরা টুটাব তিমির রাত বাধার বিন্দাচল। নজরুল ইসলামের লেখনিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এমন হাজারো কালজয়ী প্রতিবাদী উচ্চারণ। কখনো তিনি নিজেই প্রতিবাদী কখনো জাতিকে করেছেন প্রতিবাদী। তাই দ্বিধা-সংকোচহীন কণ্ঠে একথা বলতে পারি-বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুল প্রতিবাদের কাণ্ডারী।
×