ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

শান্তিনিকেতনে নারী কারুশিল্পীদের পণ্য

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ৫ অক্টোবর ২০১৮

শান্তিনিকেতনে নারী কারুশিল্পীদের পণ্য

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এক মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সম্ভাবের মিলনসৌধ। কথিত আছে ১৮৬০ সালে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা থেকে প্রায়ই ৩০০ কিমি দূরে বোলপুরে একটি জমি ক্রয় করেন। দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মধ্যে এখানে আসতেন বলে ‘শান্তি নিকেতন’ নামে একটি গৃহনির্মাণ করা হয়। কালক্রমে বোলপুরের এই বিস্তৃত অঞ্চল ‘শান্তিনিকেতন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। শুধু তাই নয় কবিগুরু নান্দনিক চেতনায় লালিত এই শান্তিনিকেতন এক অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। সৃজনশীল দ্যোতনায় নিবিষ্ট কবিও শান্তিনিকেতনের প্রতি ভীষণভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। শুধু সাহিত্যচর্চা নয়, নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনায় এই নৈসর্গিক সুরম্য নিকেতনকে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষচর্চা শ্রম থেকে শুরু করে আবহমান বাংলার চিরায়তন ঐতিহ্য তার সঙ্গে বিশ্বজনীনতার অপার সম্ভাবনার যোগসাজশে যে তীর্থ ভূমি গড়ে তুললেন আজও তা দেশে-বিদেশে উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। গ্রামনির্ভর এই কৃষিভিত্তিক অঞ্চলটি আজ অবধি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন ও জীবিকায় সময়ের দাবি মিটিয়ে যাচ্ছে। শান্তিনিকেতনের ‘বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ যেভাবে আধুনিকতার বিস্তৃত বলয়ে তার কর্মযোগকে প্রসারিত করেছে পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্যিক চেতনা সঙ্গে হরেক রকম কুটির শিল্পের নান্দনিক দ্যোতনা সাধারণ জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের আবশ্যিক পর্যায়ই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি পুরো অর্থনীতির বিরাট নিয়ামক শক্তি। অতি পুরাকাল থেকে হস্ত কারুকার্যের যে শৈল্পিক কর্ম দক্ষতা তা আজও গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে কলকাতার বিভিন্ন উন্নতমানের শপিংমলে তার যথার্থ জায়গা করে নিয়েছে। হাতের তৈরি শৈল্পিক বয়ন কাজে নারীদের অংশগ্রহণ একেবারে নজর কাড়া। সেটাও বহু আগে থেকেই। দেবেন্দ্রনাথ যবে বোলপুরে তার বসতির জায়গা করেন সেই সময় থেকে বোলপুরের আশপাশে কুটির শিল্পের যে ক্ষুদ্র অর্থনীতি গ্রামের চাহিদা মেটাত তা আজ সময়ের মিছিলে আরও বেগবান এবং গতিশীল হয়ে সীমাবদ্ধ বলয় থেকে বিস্তৃত কর্মযোগে নিজের অবস্থানকে শক্ত আর মজবুত করেছে। শান্তিনিকেতনের এই বয়ন শিল্পে গ্রামীণ নারীদের যে দক্ষতা, পারদর্শিতা, সুচারু সূচিশিল্পে যে অভিগামিনা তা যেমন দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায় একইভাবে হস্তশিল্পীরা নিজেরাও অর্থ সংস্থান করতে বেগ পায় না। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়ই ১০ কিলোমিটার দূরে এসব হস্তশিল্পীর বুটিক হাউজে যে বাহারি পণ্যের স্তূপ তৈরি হয় সেটাও তারা সপ্তাহের দুই দিনে হাটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মধ্য আর উচ্চবিত্তের ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিক্রি করা তাদের রুজি-রোজগারের নিয়মিত ব্যবস্থা। আর্থিকভাবে অসচ্ছল এই বুনন শিল্পীরা দোকান করার কথা ভাবতেও পারে না। নির্দিষ্ট একটি জায়গা জুড়ে নিজের হাতে তৈরি শিল্পকর্ম মাদুর বিছিয়ে সাজিয়ে বসে সম্পৃক্তরা। দোকান দেয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতিও তাদের নেই। সপ্তাহে রবি এবং সোমবারে হাটে বসে তারা তাদের হস্তশিল্পের মাধুর্যভরা কারুকাজ দর্শকের সামনে তুলে ধরে। সাধারণ ক্রেতারাও অপেক্ষা করে থাকে এই হাট বসার প্রত্যাশায়। ক্রেতা হিসেবেও নারীরাই বেশি। শৈল্পিক নৈপুণ্যে তৈরি এসব পণ্যের মধ্যে শাড়ি, থ্রি-পিস, কোর্তা, ফতুয়া, বিছানার চাদর, হাত পাখা, হরেক রকম মাটির গয়না, মেয়েদের হাতব্যাগÑ সবই বিক্রির জন্য সাজানো থাকে। গ্রাম-গঞ্জে খুব বেশি চড়া দামে বিক্রি করাও সম্ভব হয় না। আবার হিসেবি ব্যবসায়ীরাও নিজেদের মুনাফার দিকে এতখানি নজর দেয় ফলে মূল বুটিক শিল্পীরা এখনও নিজেদের হস্তশিল্প নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। গরিব ক্রেতাদের কাছেও বেশি দাম চাইতে গেলে বিক্রি হয় না। আবার কলকাতা থেকে আগত ব্যবসায়ীরাও খুব বেশি মূল্যে কিনতেও চায় না। হাতে বোনা শিল্পীদের কারুকার্য খচিত নান্দনিক বয়নচর্চায় তাদের জীবনযাত্রার মানে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না শুধুমাত্র পরিশ্রম করা ছাড়া। কাঁথা ফোঁড় বাংলাদেশের হস্তশিল্পের এক ঐতিহ্যিক বুনন যা আজও বয়ন শিল্পে এক অনবদ্য অবদান রেখে যাচ্ছে। কাঁথা ফোঁড়ে পারদর্শী মেয়েরা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সুতা, সিল্ক, তসের মতো মূল্যবান কাপড়ে যেভাবে তাদের শৈল্পিক দ্যোতনার ছাপ রাখে তা যেমন দর্শনীয় একইভাবে মহামূল্যবানও। কিন্তু বুনন শিল্পীরা কোনমতে সুতা আর কষ্টের মূল্যই শুধু আদায় করতে পারে। মূল মুনাফা যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে। এমন অনেক হস্তশিল্পী নারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় বংশানুক্রমিকভাবে প্রচলিত এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে তাদের এই চেষ্টা আর শ্রম। তারা নিজেরাও জানে কলকাতার বাবুরা তাদের কাছ থেকে ১০০০ টাকা দামে যে শাড়িটা কেনেন সেটা বাজারে বিক্রি হয় দশ হাজারেরও বেশি। অথচ তাদের লভ্যাংশ মাত্র ১৫০ থেকে ২০০টা। বাসা থেকে কাপড় বোঝাই বস্তা হয়ত বা নিজেকে বয়ে আনতে হয় নতুবা কোন ভ্যান কিংবা ঠেলা গাড়িতে তুলে দিতে হয়। অথচ তাদের তৈরি পণ্যে ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থা। প্রশ্ন করলে উত্তর আসে এর বাইরে অন্য কিছু তাদের কল্পনাতেও আসে না। এর পরও নিজেদের তৈরি করা বয়ন শিল্প নিয়ে তারা তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। পারিবারিক পোশাকে শুধু ধরে রাখা নয় নিত্যনতুন রকমারি বুননের যে অন্যবদ্য শিল্পবোধ সেটাও তাদের অভিভূত করে এবং আনন্দও দেয়। বাজার বাণিজ্য নিয়ে ভাবলে নিজেদের ক্ষুদ্র শিল্পকর্মকে টিকিয়ে রাখা দায় হবে। তাদের নিখুঁত হাতের বুনন যখন অন্যের শরীরে শোভাবর্ধন করে সেই আনন্দও কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। পুরো শাড়িতে কাঁথা, বকেয়া, ডাল ফোঁড় কিংবা ভরাট করতে প্রায়ই ১৫-২০ দিনের মতো সময় লেগে যায়। তাই সবাই প্রতি সপ্তাহেরর হাট ধরতেও পারে না। বয়ন শিল্পের এই ছোট ছোট বুটিক গৃহ শান্তিনিকেতনের আশপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এখানকার আর এক প্রধান শিল্পকর্ম বাটিক। বিভিন্ন রঙে শোভিত এই বাটিকের মনোহারি দ্রব্য সত্যিই আকর্ষণীয় এবং বিমুগ্ধ করার মতো। এখানেও বাটিকের শাড়ি, ফ্রি-পিস, মেক্সি, ফতুয়া, ব্লাউজের কাপড়, বিছানার চাদর সবই তৈরি করে বাটিক শিল্পীরা। কোন কাপড়ে বাটিক করতে গেলে রঙের সংমিশ্রণ এবং ডিজাইনের শৈল্পিক সুষমা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটো জিনিস চেতনায় ধারণ করতে না পারলে বাটিক বস্ত্রের মর্যাদা হানি হয়। ফলে তাদের অনেক সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হয় এই বাটিক শিল্পকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে। তবে গ্রাম-গঞ্জে এই বাটিকের তৈরি শিল্পকর্ম মূল কারিগর থেকে শোরুমে যেতে তেমন কোন অর্থের তারতম্য হয় না। কারণ চাহিদা যেমন বেশি ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের সুযোগও তেমন কম। একজন বাটিক শিল্পী তার তৈরি করা ফতুয়া কোনভাবেই ২০০-২৫০ এর নিচে ছাড়ে না। আর একজন ব্যবসায়ী বড়জোর বাজারে তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারে না। এই শিল্পেও নারীরা এগিয়ে। নারীদের তৈরি করা বাহারি রঙের বাটিকের শৈল্পিক মহিমা আজও ক্রেতাদের এই বিশেষ পণ্যটির প্রতি আগ্রহী করে তোলে। দৃষ্টিনন্দন এই বাটিকের শিল্পকর্ম শান্তিনিকেতনের প্রয়োজন মিটিয়ে পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন শপিং মলেও সরবরাহ করা হয়। তবে নিম্নবিত্তের এসব অসাধারণ শিল্পী যারা ঐতিহ্যকে লালন করে বংশ পরম্পরায় এই পেশাকে গতিশীল করে রেখেছে তারা কিন্তু বাজার অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্যিক কারণের অপকৌশল থেকে এখনও অনেকটাই দূরে। ফলে কাপড়, রং এবং ডিজাইনের যে অপরূপ শিল্পকর্ম তা যেমন অনন্য মাত্রার একইভাবে সততারও এক চমৎকার নিদর্শন। সেই কারণে ক্রেতা সাধারণের মনোরঞ্জন করতে তাদের বেশি বেগ পেতে হয় না। মূল কারিগরদের আনন্দ এবং পরিতৃপ্তি এখানেই।
×