ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মরণোত্তর সনদ প্রাপ্তি

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ৫ অক্টোবর ২০১৮

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মরণোত্তর সনদ প্রাপ্তি

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এক বিপ্লবী অগ্নিকন্যা। চট্টগ্রামের এই লড়াকু নারী আজও বিদ্রোহী সত্তায় সবাইকে উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছেন। তিনি শুধু নারী জাতির প্রতিনিধি নন অত্যাচারিত, নিগৃহীত সব মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত শিখা। যে অনির্বাণ দীপ্তি পরাধীন দেশের মুক্তির লক্ষ্যে নিরন্তর প্রজ্বলিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণীয় আবহ কাটতে না কাটতেই বিংশ শতকের সূচনালগ্নে শুরু হয়ে যায় উপমহাদেশীয় উত্তাল রাজনৈতিক ¯্রােত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীতে স্বদেশী আন্দোলন এবং সবচেয়ে তীব্র আঁচড় বসে কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে নতুনভাবে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের অভ্যুদয়। যা কালক্রমে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে সময় নেয়নি। শুধু তাই নয় অনিবার্য পরিণতিতে ’৪৭-এর দেশ বিভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। বঙ্গভঙ্গকে কবিগুরু কখনই পছন্দ করেননি। কলকাতার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন রাখি বন্ধনের অভাবিত কর্মযোগে। শুধু তাই নয় সিংহভাগ দেশত্মাবোধক গান রচনা করেন বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে। জীবনীকার প্রভাত কুমার বলেন- ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে কবিগুরু লালন বাউলের দেশ কুষ্টিয়ার শিলাইদহে দীর্ঘ সময় কাটান জমিদারি তদারকিতে। কিন্তু সঙ্গীতগুরু রবীন্দ্রনাথের গানে সেই অবধি কোন বাউল সুর সংকৃত হয়নি। বিশ্বকবি তাঁর গানের ভা-ারে বাউলের সুর সংযোজন করছেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর থেকে। শিলাইদহে বাউল গগন হরকরা কবিকে প্রায়ই গান শুনিয়ে যেত। তার মধ্যে একটি গান ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে’ এই সমৃদ্ধ বাণীটি কবির হৃদয়ের নিভৃতে গেঁথে ছিল। বঙ্গভঙ্গের সেই ঐতিহাসিক পর্বে শান্তিনিকেতনের নির্জন পরিবেশে ঝঙ্কৃত হলো নতুন আর একটি গভীর শব্দ চয়নের কথামালা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ সুরও বসিয়ে দিলেন একেবারে নিজের মতো করে। বিশ শতকের প্রথম দশকের অগ্নিঝরা পরিক্রমা শেষ না হতেই শুরু হয় দ্বিতীয় দশকের ভিন্নমাত্রার উপমহাদেশীয় কোন্দল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়- কিন্তু তার সুতীক্ষè থাবা দুই বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনে যে পর্বত প্রমাণ বোঝা চাপায়- সে ভার আজও লাঘব হয়নি। এর পরবর্তী ইতিহাস দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ’৪৭-এর দেশ বিভাগের বিক্ষুব্ধ পথযাত্রা। ব্রিটিশ মুক্ত দেশ উপহার পাওয়ার বিনিময়ে সবাই পেল সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের এক ঝড়ঝঞ্ঝার অভ্যন্তরীণ বিরূপ প্রতিবেশ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বৈপ্লবিক পরিবেশে অবিভক্ত ভারত তখন বিপন্ন, বিপর্যস্ত এবং প্রায়ই দিশেহারা। আর এমনই বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক অস্থিরতায় জন্ম নেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। যাকে সবাই চিনত রানী নামে। ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের যুগান্তকারী সময়ে জন্ম নেয়া রানী শৈশব-কৈশোর পার করেছেন অবিভক্ত বাংলার চরম দুঃসময়ে। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রাম। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে এই গ্রামের অনেক বিপ্লবী তৎকালীন সময়ে যে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে নামেন সেই গ্রামেরই এক অতিসাধারণ কন্যা রানী পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ও মাতা প্রতিভা দেবীর ছয় সন্তানের মধ্যে রানী দ্বিতীয়। বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের কর্মকর্তা, অসাধারণ ধীর স্মৃতিশক্তির অধিকারী রানীর অতি বাল্যকাল থেকে তার মেধা ও মননের পরিচয় দিতে থাকে বাবা মায়ের হাতে তার লেখাপড়ার শুরু। মেধাবী রানী পারিবারিক শিক্ষায় নিজেকে এমনভাবে তৈরি করে যাতে সে একেবারেই সরাসরি তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। সে সময়ের (এখনও তাই) চট্টগ্রামের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডাঃ খস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করাও ছিল এক দুর্লভ ব্যাপার। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রীতিলতা তার কৃতিত্বের ছাপ রাখতে কখনও পিছপা হননি। অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও লাভ করেন। ১৯২৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রী নিবাসে থাকারও সুবাদে অনেক জ্ঞানী-গুণী এবং বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসতে তার সময় লাগেনি। বিখ্যাত বিপ্লবী লীলা নাগের সঙ্গে রানীর সখ্য আর হৃদ্যতা তাদের সংগ্রামী জীবনের এক অনন্য যুগ সন্ধিক্ষণ। চট্টগ্রামের আর এক বিপ্লবী যোদ্ধা পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন প্রীতিলতার খুড়তুত ভাই। এদের অনুপ্রেরণায় রানী নিজেকে বিপ্লবী চেতনায় ভেতর থেকে তৈরি করতে থাকেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে এক পর্যায়ে ইতিহাসের কিংবদন্তি লড়াকু বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্যসেনের সঙ্গেও রানীর পরিচয় চট্টগ্রামের সংগ্রামী বলয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগ। তৎকালীন সময়েও নারীরা আলাদা সংগঠন করত। কিন্তু রানীর বেলায় তা কার্যকর হয়নি। তিনি মূলত বিপ্লবের মূল সংগঠনে তার অংশীদারিত্ব জোরালোভাবে সংযুক্ত করলেন, তাও এক ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা। চট্টগ্রামের বিপ্লবী সংগঠনের দায়িত্বে থাকা সূর্যসেন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতেন। ইতোমধ্যে প্রীতিলতা কৃতিত্বের সঙ্গে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার শুভযোগ হলো। কলকাতার বেথুন গার্লস কলেজে ¯œাতক পর্বে ভর্তি হলেন। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি পাবারও সুযোগ হলো। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী কার্যক্রমও থেমে থাকল না। সারা বাংলা কেঁপে উঠল স্বদেশী আন্দোলনের লড়াকু সৈনিকদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং সশস্ত্র আক্রমণে। এমন উত্তেজক সময়ে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়েও ¯œাতক শেষ পর্ব সম্পন্ন করেন। ডিসটিংশনে পাস করে সসম্মানে এখানেও তার সফলতার ছাপ রাখলেন। ১৯৩২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ¯œাতক ডিগ্রী অর্জনকারী প্রীতিলতাকে ঔপনিবেশকি শক্তি তার প্রাপ্ত নম্বর এবং সনদপত্র থেকে প্রায়ই বঞ্চিত করে রাখে। প্রীতিলতা নিজেও জানতে পারেননি। তার প্রাপ্ত নম্বর এবং উত্তীর্ণ বিভাগ। পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ এই অকুতোভয় বিপ্লবীর শিক্ষার্থী জীবনের সর্বশেষ অর্জনটিকে একেবারে রুদ্ধতার অন্ধকারে আটকে রাখে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষার ফলাফল ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের পক্ষে নাট্যকার রতন ঘোষকে এই নম্বর ও সনদপত্র প্রদান করে। সনদটি প্রস্তুত করার তারিখ দেখানো হয় ১৯৩৩ সালে ২৫ মার্চ। প্রায় ৮৬ বছর পর হাতে পাওয়া এই সনদপত্রে দেখা যায় ওয়াদ্দেদার সব মিলিয়ে ৬১৮ নম্বর পেয়ে কৃত্রিত্বের সঙ্গে বিএ ডিগ্রী অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তী বিধি মোতাবেক এই সনদপত্র হস্তান্তর করেন। দেখে যেতে পারলেন না তার এই অসামান্য সাফল্যের সনদপত্রটি। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এক সশস্ত্র বিপ্লবী আক্রমণে শরিক হয়ে পরবর্তীতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হন। নিজেকে ধরা না দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আজও বিপ্লবী উদ্দীপনার সংগ্রামী অভিযাত্রায় প্রীতিলতা অবিস্মরণীয় এক মাইলফলক। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×