ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধীদের বোঝা হিসেবে না দেখে জনসম্পদে রূপ দেয়ার তাগিদ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৫ অক্টোবর ২০১৮

প্রতিবন্ধীদের বোঝা হিসেবে না দেখে জনসম্পদে রূপ দেয়ার তাগিদ

নিখিল মানখিন ॥ মেডিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রমে অটিজম বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে অটিস্টিকদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে সব ধরনের প্রতিবন্ধীর সংখ্যা অর্ধ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করা দরকার। একজন প্রতিবন্ধীর জীবনে বঞ্চনা ও বিচ্ছিন্নতার একটি পর্যায়ক্রমিক ধারা সৃষ্টি করে। প্রায় অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীতে এমনকি সরকারী-বেসরকারী উভয় প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে অবহেলা ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়। তাদের প্রতি অসম দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে এখনও সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘অটিজম’ বিষয়টি আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি অত্যাবশ্যকীয় ইস্যু হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা, গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান সায়মা হোসেনের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে উন্নয়ন কর্মকা-ে সকলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। দেশের অটিস্টিক ব্যক্তি ও শিশুরা আমাদের আপনজন। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নয়নের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে তারাও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। অটিজম মোকাবেলায় সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অটিজমসহ সকল প্রকার শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা মানববৈচিত্র্যেরই অংশ। এদিকে, ভিন্ন মানববৈচিত্র্যের এ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে গত ৮ বছর ধরে সরকার ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে। গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ ইনিশিয়েটিভ ইন বাংলাদেশের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান সায়মা হোসেন ২০১২ সালে জাতিসংঘে অটিস্টিক শিশু ও তার পরিবারের সহায়তায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তার পরিবারের জন্য আর্থ-সামাজিক সহায়তা শীর্ষক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যা সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। দেশে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুল স্থাপন, ঢাকার মিরপুরে জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, সরকারী চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ, ৬৪ জেলায় ৬৮টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। দেশব্যাপী প্রতিবন্ধিতা শনাক্তরণ জরিপের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিকসহ সকলক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীর সমধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি দেশী-বিদেশী সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ ও বিত্তবানদের প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবন্ধী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক ও বঞ্চনার শিকার প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুরা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। অনেক পরিবারে তাদের দেখা হচ্ছে বোঝা হিসেবে। বোঝা হিসেবে না দেখে প্রতিবন্ধীদের জনসম্পদে রূপ দিতে হবে। আর সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাদের বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেডিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রমে অটিজম বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অটিজম বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ডাক্তার ও নার্স প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং উপজেলা পর্যায়ে প্যারামেডিক্স ও অভিভাবকদের অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আর দেশের ১৫টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে অটিজম ও অন্যান্য নিউরোডেভেলপমেন্ট সমস্যাজনিত শিশুদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। অটিস্টিক শিশু শনাক্তকরণের জন্য সাতটি বিভাগের সাতটি জেলায় বাড়ি বাড়ি স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। পাইলটিং কার্যক্রমের অভিজ্ঞতার আলোকে চলতি সেক্টর কর্মসূচীতে সারাদেশকে এই কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, অটিস্টিক এবং প্রতিবন্ধীরা সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে সে লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার। প্রতিবন্ধীদের প্রতি দায়িত্ব যেমন তাদের অভিভাবকদের রয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রেরও রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদানের জন্য প্রতিটি উপজেলায় ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র’ চালু করা হবে। অটিস্টিকসহ সমাজের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এ মর্যাদা ভোগের সমান অধিকার রাখেন। অটিজম কোন ব্যাধি নয়, এটা জন্মগত একটি অসুবিধা। প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় ৭৩টি ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার বা ‘প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র’ চালু রয়েছে। এ সব কেন্দ্রের সঙ্গে একটি করে অটিজম কর্নারও চালু করা হয়েছে। এ কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। প্রতিবন্ধিতা মানববৈচিত্র্যের একটি অংশ। তাদের প্রতি অবজ্ঞা করার সময় শেষ হয়েছে। তাদের অধিকার এবং মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রতিটি মানুষেরই জন্মগতভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন, ২০১৩ নামে দুটি আইন পাস হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। এ ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এ ফাউন্ডেশনকে ‘প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদফতর’-এ রূপান্তর করা হয়েছে। এই কার্যক্রম উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে একটি করে প্রতিবন্ধী কর্মজীবী পুরুষ ও মহিলা হোস্টেল, অটিজম রিসোর্স সেন্টার ও অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে ইশারা ভাষার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া অটিস্টিক শিশুর মায়েদের জন্য প্রাত্যহিক লালন-পালনসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাউন্ডেশন ক্যাম্পাসে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শ্রবণ, বুদ্ধি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়কে মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবাসিক সুবিধা রাখা হয়েছে। দেশের ৫৫টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের মাধ্যমে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন সঠিক পরিসংখ্যান ছিল না। এ জন্য ২০১৩ সাল থেকে সরকার সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হবে। বিশেষ সুবিধা হিসেবে তাদের কিছু ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, অটিজম সম্পর্কে এখনও দেশের মানুষের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে অটিস্টিক শিশুদের ব্যবহারের কারণে পাগল বলা হয়। এমনকি ভুল চিকিৎসা করে অনেক শিশুকে অকালে মেরে ফেলা হয়। তিনি বলেন, অটিস্টিক শিশুরা বিশেষ কোন ক্ষেত্রে খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাই এদের প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত না করে বিশেষ শিশু বলা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা গেলে অটিজমের হাত থেকে অনেক শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।
×