ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ

ডেঙ্গুজ্বর ॥ তথ্য ও পথ্য

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৫ অক্টোবর ২০১৮

ডেঙ্গুজ্বর ॥ তথ্য ও পথ্য

মে থেকে অক্টোবর মাস বিশেষ করে বর্ষাকালে থাকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, শীতের আগমনের আগ পর্যন্ত চলতেই থাকবে। কিন্তু এ বছরের শুরু থেকেই বেড়ে চলেছে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ, কারণ মাঝেমাঝে হালকা বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার প্রধান প্রজননক্ষেত্র। ফলে মশার বংশবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। যেহেতু বর্তমান মৌসুমটা ডেঙ্গুজ্বরের আর মশার প্রকোপ এবং তার বংশবৃদ্ধি কমানো যায়নি, তাই যে কেউ এই সময়ে জ্বরে আক্রান্ত হলে ডেঙ্গুজ্বরের কথা মাথায় রাখতে হবে। সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা না করে, ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। কারণ, অহেতুক অবহেলার কারণে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশ কিছু রোগীর মৃত্যুর ঘটনা জনগণকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। যদিও গত কয়েক বছরে ডেঙ্গু নিয়ে অযথা আতঙ্ক ও ভুলভ্রান্তি অনেকটাই কমে এসেছে, তারপরও রয়ে গেছে নানা প্রশ্ন। ডেঙ্গু কোন নতুন রোগ নয়, এর উপসর্গের সঙ্গে মিল আছে এমন জ্বরের প্রথম মহামারীর ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় ৯৯২ খ্রিস্টাব্দে চীনে (যা ‘পানি বিষ’ নামে বর্ণিত)। পরবর্তীতে ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে পানামায় যে জ্বরের মহামারীর বিবরণ পাওয়া যায়, সেটি ডেঙ্গু বলেই ধারণা করা হয়। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে একই সঙ্গে মহামারীর বিবরণ পাওয়া যায় কায়রো (ম্যাল দ্য জেন্যু) এবং বাটাভিয়ায় (নকেলকুর্টস বা বোন ফিভার) এবং ১৭৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় (বিলিয়াস রেমিটিং ফিভার/ ব্রেকবোন ফিভার)। এশিয়াতে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের প্রথম মহামারী হয় ১৯৫৩/৫৪ সালে ম্যানিলায় এবং পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে ব্যাংকক ও থাইল্যান্ডে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রথম ব্যাপক আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৬৪ সালে, যা পরিচিত ছিল ‘ঢাকা ফিভার’ নামে। এই শতাব্দীর শুরুতে ২০০০ সালে ডেঙ্গুজ্বর বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ হয়ে পড়ে আতঙ্কগ্রস্ত। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং পরিবার-পরিজন অনেকেই হয়ে পড়েন দিশেহারা। শত শত রোগীর রক্ত এবং প্লাটিলেট জোগাড় করতে গিয়ে ব্লাড ব্যাংকগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিল। আর রক্ত বা প্লাটিলেট সংগ্রহ করার জন্য লোকজনও হয়ে উঠেছিল মরিয়া। এ সময়টাতে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতাও ছিল সীমিত। ফলে পুরো জাতিই দিগি¦দিকশূন্য এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। মিডিয়াতেও এর ব্যাপক প্রচার পায়। তবে বর্তমানে মানুষের ঐ ভীতি ও আতঙ্ক কেটে গেছে। ডাক্তাররা যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। জনগণও এর প্রতিকার ও প্রতিরোধে যথেষ্ট সচেতন। ডেঙ্গুজ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা, সাধারণত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তবে কিছুকিছু ক্ষেত্রে এডিস এ্যালবপটিকাস নামক মশার কামড়েও এই রোগ ছড়াতে পারে। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। ডেঙ্গুজ্বর কখন ও কাদের বেশি হয়? সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালান-কোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গুজ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু একেবারেই হয় না বললেই চলে। ডেঙ্গু ভাইরাস ৪ ধরনের, ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। তাই ডেঙ্গুজ্বরও ৪ বার হতে পারে। যারা একবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ : ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫º ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি, মাংসপেশী, মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে তীব্র ব্যথা হয়। এমনকি ব্যথা এত তীব্র হয়, মনে হয় হাড় বুঝি ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যথার তীব্রতায় শিশুকে স্পর্শ করলেই কেঁদে ওঠে, খিটখিটে মেজাজের হয়। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এরসঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোন কোন রোগীর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে বাইফেজিক ফিভার বলে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর : এই অবস্থাটাই সবচেয়ে জটিল, যেখানে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা হয়, যেমন শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, মেয়েদের বেলায় সময়ের আগেই মাসিক হওয়া বা মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। এমনকি মস্তিষ্ক এবং হার্টেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে হাইপোভলিউমিক শকে গিয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়া বুকে পানি এবং শ্বাসকষ্ট, পেটে পানি, লিভার আক্রান্ত হয়ে জন্ডিস, কিডনি আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম : ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, হঠাৎ করে রোগী অজ্ঞান হতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বর্তমানে ডেঙ্গুর ধরন : এবারে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণের ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। জ্বরের তীব্রতা, তীব্র শরীর ব্যথা এবং র‌্যাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, ফলে রোগীরা সাধারণ জ্বর মনে করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করছেন এবং যথাযথ চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করছেন। ফলে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেক রোগীর অবস্থার হঠাৎ অবনতি হচ্ছে, কোন কোন রোগী হেমোরেজিক ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মতো মারাত্মক জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। শেষমূহূর্তে সামাল দিতে ডাক্তারদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসা করতে। ভোগান্তি বাড়ছে রোগীদের। কি কি পরীক্ষা করা উচিত? আসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুজ্বর হলে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার নেই, এতে অযথা অর্থের অপচয় হয়। রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট জ্বর শুরুর ৪ বা ৫ দিন পর কমতে শুরু করে, তাই ৪ বা ৫ দিন পর রক্তের সিবিসি এবং প্লাটিলেট পরীক্ষা করা উচিত। এর আগে করলে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকে এবং অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন যে রিপোর্ট ভাল আছে, তাই আর কোন পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। আবার অনেকেই দিনে দুই-তিনবার এবং একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়। প্লাটিলেট কাউন্ট ১ লক্ষ্যের কম হলে, ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পাশাপাশি ১-২ দিনের জ্বরে ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন এবং ৪ থেকে ৬ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু এন্টিবডি করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাগুলো রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করলেও চিকিৎসায় কোন ভূমিকা নেই। এই পরীক্ষা না করলেও কোন সমস্যা নেই, এতে শুধু অর্থের অপচয় হয়। চিকিৎসক যদি মনে করেন তবে প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষা, পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, বুকের এক্সরে এবং ডিআইসি জাতীয় জটিলতার পরীক্ষা করতে পারেন। চিকিৎসা পদ্ধতি : ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। এই জ্বর সাধারণত এমনিতেই ভাল হয়ে যায়, এমনকি কোন চিকিৎসা না করালেও। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, যাতে ডেঙ্গুজনিত কোন জটিলতা না হয়। ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত, তাই উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল খেতে পারবেন, অন্য কোন ব্যথার ওষুধ যেমন এস্পিরিন, ডাইক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন কোনক্রমেই খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। প্রচুর পানি এবং তরল খাওয়ানো উচিত। খেতে না পারলে বা অন্য কোন প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন বা গ্লুকোজ ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। কিছুকিছু লক্ষণ দেখা দিলে অতিসত্বর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। যেমন প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে, শরীরের যে কোন অংশ থেকে রক্তপাত হলে, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে, জন্ডিস দেখা দিলে, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে, প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে। এসব ক্ষেত্রে অবহেলা না করে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে কোন মশা কামড়াতে না পারে। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো মশা অন্য সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার ডেঙ্গুজ্বর হতে পারে এবং এভাবেই ডেঙ্গু অন্যদের মাঝে ছড়ায়। ডেঙ্গুজ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? ডেঙ্গুর কোন ভ্যাক্সিন নেই। যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাস চার টাইপের, তাই এই চারটি ভাইরাসের প্রতিরোধে কাজ করে, এমন ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পারে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং এডিস মশা প্রতিরোধ। ব্যক্তিগত সতর্কতা : ১. এডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাতে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে। ২. দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে। ৩. প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে। ৪. বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পড়াতে হবে। বসতবাড়ির মশা নিধন : যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, বাড়িঘরে এবং আশপাশে যে কোন পাত্র বা জায়গায় জমে থাকা পানি ৩ থেকে ৫ দিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মারা যায়। পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ঘষে পরিষ্কার করলে ভাল। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে এবং মুখ খোলা পানির ট্যাংকে যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির ছাদে অনেককে বাগান করতে দেখা যায়, সেখানে টবে বা পাত্রে যেন জমা পানি ৫ দিনের বেশি না থাকে, সেদিকেও যতœবান হতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বসতবাড়ির বাইরে মশার বংশ বিস্তার রোধ : ১. ঘরের বাইরে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়ার ফলে পানি জমতে পারে। যেমন ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারির শেল, পলিথিন/চিপসের প্যাকেট। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে। ২. মশা নিধনের জন্য স্প্রে বা ফগিং করতে হবে। ৩. বিভিন্ন রাস্তার আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ফুলের টব, গাছপালা, জলাধার ইত্যাদি দেখা যায়। এখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে পারে। সেগুলোতেও যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যপারে যতœবান হতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ে খুব স্বভাবতই জনমনে যেসব প্রশ্ন জাগে: ১. ডেঙ্গু থেকে জীবনাশঙ্কা আছে কি? ডেঙ্গুজ্বর তেমন মারাত্মক কোন রোগ নয়। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রাণঘাতী হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মতো চিকিৎসা নিলে প্রাণহানির আশঙ্কা ১% এরও কম। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। ২. জ্বর কমে গেলে কি সব বিপদ কেটে গেল? ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত ৫-৬ দিন থাকে এবং তারপর সম্পূর্ণ ভাল হয়। জ্বর কমে গেলে অনেক রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করেন, রোগ সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরে মারাত্মক সমস্যা হবার সময় আসলে এটাই। এ সময়ই প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাবার পরবর্তী সময়টাকে তাই বলা হয় ‘ক্রিটিকাল পিরিয়ড’। এসময় সবারই সচেতন থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী। ৩. ডেঙ্গুজ্বরে কি কি পরীক্ষা কখন করা উচিত? সাধারণত বেশি টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না। সিবিসি এবং প্লাটিলেট কাউন্ট করলেই যথেষ্ট। তবে জ্বরের শুরুতে রক্ত পরীক্ষা করালে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকবে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন, রিপোর্ট ভাল আছে, তাই আর কোন পরীক্ষার প্রয়োজন নেই, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্লাটিলেট কাউন্ট ৪ বা ৫ দিন পর কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর ৪-৫ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। আবার অনেকেই দিনে দুই তিনবার, এমনকি একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়। ১-২ দিনের জ্বরে ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন এবং ৪ থেকে ৬ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু এন্টিবডি করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাগুলো রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করলেও চিকিৎসায় কোন ভূমিকা নেই। ৫. রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি? ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলেই রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে, তবে রক্ত পরিসঞ্চালন করার কোনও প্রয়োজন নেই। ৬. প্লাটিলেট কি দিতেই হবে? ডেঙ্গু জ্বরের ৪ বা ৫ দিন পরে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ২-৩ দিন পর তা বাড়তে শুরু করে কোন চিকিৎসা ছাড়াই। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের কোন প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় প্লাটিলেট একটু কমে গেলেই রোগী এবং চিকিৎসক প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। আবার, তাড়াহুড়া করে প্লাটিলেট এমনকি রক্ত পরিসঞ্চালন করলে হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি ইত্যাদি সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ৭. একবার ডেঙ্গু হলে আর কি হয় না? এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কেননা, ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি ভিন্ন প্রজাতি বা সেরোটাইপ আছে, তাই ৪ বার ডেঙ্গু হবার সম্ভাবনা থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোন একটি প্রজাতি দ্বারা একবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভবিষ্যতে সেই সেরোটাইপ দ্বারা আর আক্রান্ত হয় না। কারণ শুধু সেই সেরোটাইপটিতে রোগীর আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু বাকি ৩টি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিকই রয়ে যায়। তবে কেউ যদি পৃথকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি প্রজাতি দ্বারা জীবনে ৪ বার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি জীবনে আর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়। ৮. মা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে কি? মায়ের বুকের দুধে এই ভাইরাস থাকে না। কাজেই, আক্রান্ত অবস্থায় মা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। ৭. ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ? ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে একত্রে থাকা যাবে কি? ডেঙ্গু কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে, একই তোয়ালে, একই গ্লাস কিংবা প্লেট ব্যবহার করলে অন্যদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় কোনও বাধা নেই। ৮. এন্টিবায়োটিক দেয়া যাবে কি? ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এতে এন্টিবায়োটিকের কোন ভূমিকা নেই। তবে ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগও থাকতে পারে, তখন এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হতে পারে। অনেকে মনে করেন ডেঙ্গুতে এন্টিবায়োটিক ক্ষতি করতে পারে এবং তা পরিহার করতে হবে, যা একটি ভুল ধারণা। ডেঙ্গুজ্বরে প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে রোগীর কোন ক্ষতি হবে না। ৯. গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কি করণীয়? এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই এ সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ। উপসংহারে বলা যায়, ডেঙ্গুজ্বর হয়তোবা নির্মূল করা যাবে না, এর কোন ভ্যাক্সিন কিংবা কার্যকরী ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গুজ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×