ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা আন্দোলন ও শিক্ষক সমাজ

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৫ অক্টোবর ২০১৮

শিক্ষা আন্দোলন ও শিক্ষক সমাজ

১৯৬২ সালে শরীফ কমিশনের সুপারিশে অবৈতনিক শিক্ষার ধারণাকে অবাস্তব কল্পনা বলে পরিহাস করে এবং সার্বজনীন শিক্ষার গণদাবিকে নির্বিচারে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল। ছাত্রসমাজ সঙ্গে সঙ্গে ‘শরীফ কমিশন’ প্রতিবেদনকে একটি অগণতান্ত্রিক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নিয়েছিল। সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার দাবিতে ১৯৬২ সালে স্কুলের ছাত্রী হয়েও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে তার নেতৃত্বে মিছিল গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। অগণতান্ত্রিক ‘শরীফ কমিশন’ শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সারা বাংলার ছাত্রসমাজ সেদিন বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। উত্তাল সমুদ্রের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-মিছিলে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুলিশ গুলি চালালে বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। আহত হন অসংখ্য ছাত্র-জনতা। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন এবং ছাত্র অভ্যুত্থানের তৃতীয় দিনের মধ্যে সরকার ‘শরীফ কমিশন’ রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। বাংলার ছাত্রসমাজ বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন। এ বিজয় ছাত্রসমাজ ও ছাত্র সংগঠনগুলোর জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দিয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ জাতীয়করণের মাধ্যমে যা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর তৃতীয়তম স্তম্ভ হওয়ায় আর দশটি উন্নত, উন্নয়নশীল দেশের মতো রাষ্ট্রকেই মুখ্য দায়িত্বে থাকার প্রস্তাব করা হয়েছিল কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে। ’৭২-এর সংবিধানে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শিক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। মানবাধিকারের মূলমন্ত্র হলো ‘সাম্য, সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা।’ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হচ্ছে কি-না, এটি গুরুত্বপূর্ণ। সব কিছুর মূলে হলো বৈষম্য নিরসন। শিক্ষায় বৈষম্য না কমলে টেকসই শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ জাতির ভবিষ্যত গড়ে তোলার একটি মৌলিক দলিল। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদানের অঙ্গীকার রয়েছে, পর্যায়ক্রমে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের সুপারিশ রয়েছে। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ‘সঙ্কট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত বিনির্মাণে রূপকল্প ২০২১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘শিক্ষা’ উপ-শিরোনামেও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণায় বেসরকারী শিক্ষকরা নতুন করে আশায় বুক বেধেছিল? কিন্তু শিক্ষকরা তার বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে না পেয়ে চরমভাবে হতাশা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলে ও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সরকারী-বেসরকারী দ্বারায় দ্বৈত সুযোগ-সুবিধায় বিভক্ত। অথচ সারাদেশের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ২% সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বল্প ব্যয়ে পড়াশোনা করছে দেশের ধনিক শ্রেণীর সন্তানরা, বাকি ৯৮% বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ ব্যয়ে পড়াশোনা করছে সুবিধা বঞ্চিত, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তান। যাদের সামর্থ্য সীমিত অথচ শিক্ষা খাতে ব্যয় অনেক বেশি। বৈষম্যের বেড়াজালে বিধ্বস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার দুই ধারা সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে এমপিওভুক্ত, নন এমপিওভুক্ত, খ-কালীন শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। দিন দিন এ বৈষম্য বেড়েই চলেছে। ২০১৫ সালে সরকার জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষণা করলেও এমপিওভুক্ত বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে মূল বেতন ছাড়া জাতীয় বেতন কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ৫% বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, মূল বেতনের ৪৫% বাড়ি ভাতা, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, ১০০% উৎসব ভাতা, ২০% বৈশাখী ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, আবাসন সুবিধা, পেনশনসহ সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধাগুলো কার্যকর না করায় তৈরি হয় পাহাড়সম বৈষম্য। বার বার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার শিকার স্বল্প বেতনের স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা কয়েক বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনশন করেছেন ন্যায্য দাবি আদায়ে। শিক্ষকরা শিক্ষা জাতীয়করণ করার যে দাবি করেছেন তা আবদার নয়, সেটা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এক্ষেত্রে সরকার সুচিন্তিত নীতি বা কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করার সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্ত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রাটি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। এ সুযোগ তখনই তৈরি হবে যখন শিক্ষকদের আর্থিক দুর্দশা ও বেতন ভাতায় বৈষম্য থাকবে না। বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতির জন্য কখনই ভাল কিছু আশা করা যায় না। বেসরকারী শিক্ষকরা এসব সমস্যার সমাধান দেখেন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে একটি মধ্যম আয়ের উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে, বিষয়টি এখন আর কল্পনা বা অনুমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আপনার সরকারের টানা দশ বছর মেয়াদকালে অর্থনীতির অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। আপনার সরকারও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালের মধ্যে পৃথিবীর উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে। শিক্ষকদের প্রত্যাশা আপনার মাধ্যমে দেশের বেসরকারী শিক্ষকদের বঞ্চনার অবসান ঘটবে। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের মাধ্যমেই শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর হবেÑ এই প্রত্যাশা আমাদের। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×