ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকান মধ্যবর্তী নির্বাচনের উত্তেজনা এখন তুঙ্গে

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ৫ অক্টোবর ২০১৮

আমেরিকান মধ্যবর্তী নির্বাচনের উত্তেজনা এখন তুঙ্গে

নানামুখী উত্তেজনা নিয়ে আমেরিকার আসন্ন মিডটার্ম ইলেকশন এসে দাঁড়িয়েছে মার্কিন রাজনৈতিক অঙ্গনে। এরই মুখে মার্কিন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে জাজ ব্রেট ক্যাভানোর নিয়োগ বিষয় যেন নির্বাচনের ঘৃতে ঢেলেছে আগুন। ব্যাপারটি নিয়ে বর্তমান সময়ে আমেরিকানরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন চরমভাবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কর্তৃক এই বিচারপতিকে সুপ্রীমকোর্টের জন্য মনোনয়ন দেয়ার পরপরই ৩৬ বছর আগে এক স্কুল পার্টিতে ১৫ বছর বয়সে যৌন নিগ্রহের চেষ্টার দায়ে ড. ক্রিস্টিন ব্লাজিও ফোর্ড এক অভিযোগ আনেন জাজ ক্যাভানোর বিরুদ্ধে। সেটি নিয়ে সিনেট শুনানির শো ডাউনে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল রাজনীতির মাঠ থেকে সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত দলীয় রাজনীতির নগ্ন এবং কুটিল চেহারা। নির্বাচিত হওয়ার পর পরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম সফলভাবে একজন সুপ্রীমকোর্টের জাজকে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই দ্বিতীয়বার দেশের সুউচ্চ আদালতে জাজ হিসেবে পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে গিয়ে পড়ে গেলেন অভাবনীয় গ্যাঁড়াকলে। প্রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ক্রিস্টিন ব্লাজিও ফোর্ড নামে এক মহিলা সিনেট কনফার্মেশন আটকাতে অভিযোগ আনলেন জজ ক্যাভানোর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তা চেষ্টার। বলাবাহুল্য, রক্ষণশীল এই বিচারকের বিরুদ্ধে ক্রিস্টিন ব্লাজিওর পক্ষ নিয়েছে ডেমোক্র্যাট দল। অপরদিকে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা আসলে ক্রিস্টিনের পক্ষে ঘটনার উস্কানিদাতা। কিন্তু ডেমোক্র্যাট দল এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে তারা প্রকৃতপক্ষে পর্দার অন্তরালে সত্য লুকিয়ে আছে কি-না সেটি জানতে চায় এবং এই বিষয়ে তাদের দাবি এফবিআই তদন্ত। বর্তমানে জজ পদে কর্মরত এই বিচারিকের চাকরিপূর্ব সময়ে এফবিআই ছয়বার তদন্ত চালাবার পরও তার বিরুদ্ধে এই রকম কোন অপকর্মের সন্ধান মেলেনি। যিনি একমাত্র এই তদন্ত আদেশ দিতে পারেন সেই প্রেসিডেন্ট সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির দাবি মেনে নিয়ে এফবিআই তদন্ত করার আদেশ দিলেন। এখানে বলা প্রয়োজন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতির পদ একটি আজীবন পদ এবং এই পদের অবসরের নির্দিষ্ট কোন মেয়াদ নেই। আরও উল্লেখ্য, এমন একটি পদের জন্য কেবল বিচারপতিদের বিবেচনা করা হয় না বরং রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নামী ব্যক্তিত্বরাও এই পদের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারেন। সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি পদ শূন্য হলে প্রেসিডেন্ট তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে সেনেটরগণের পরামর্শ নিয়ে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। বলাবাহুল্য, মার্কিন সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিরা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এই দুই ভাগে বিভক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে এই দলীয়করণ শুরু হয়েছে আশির দশক থেকে। আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে দেশ দুনিয়ার সংবাদপত্রে খবর ছাপা হচ্ছে। কিন্তু মার্কিন দেশের এই মধ্যবর্তী নির্বাচন ব্যাপারটি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে কারও কারও সঙ্গে আলাপের প্রেক্ষিতে মনে হলো দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কারও কারও মধ্যে যেন কিঞ্চিৎ হলেও অস্বচ্ছতা রয়েছে। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি আমাদের দেশে বিরোধীদলীয় নেতারা যাদের মধ্যে রয়েছেন কিছু প-িত মানুষ এমনকি রাজনৈতিক ও শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত। কিন্তু আমেরিকান কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট সদস্য নির্বাচনের এই ভোট সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বছরজুড়ে তাদের মুখে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে উচ্চারিত হয় পদত্যাগ করে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন আয়োজনের জন্য। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন বলে কোন বিধান নেই। সে যাই হোক চলতি সালে এই নির্বাচন হচ্ছে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫টি এবং সিনেটের মোট ১০০ সিটের মধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়া ৩৫টি আসনে ভোটাভুটির ধার্যকৃত দিন আগামী ৬ নবেম্বর মঙ্গলবার। ওই দিন আমেরিকার ৩৯টি স্টেট ও টেরিটোরিয়াল গবর্নর পদেও প্রার্থী নির্বাচন করতে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট এই আইনসভা কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ হচ্ছে সিনেট এবং নি¤œ কক্ষটির নাম হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদ। কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য সকলেই দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং তাদের নির্বাচন পর্ব সমাধা হয় একই সঙ্গে। কিন্তু সিনেট প্রার্থীদের বেলায় সেটা প্রযোজ্য না হয়ে সিনেট পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কেবল মেয়াদ উত্তীর্ণ প্রার্থীদের জন্য। বলাবাহুল্য, সিনেট সিটে নির্বাচন হয় ছয় বছরের জন্য। ২০১৮ সালের আসন্ন মিডটার্মে কেবল যে ৩৫টি সিনেট সিটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার মধ্যে ২৩টি আসনে রয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচিত সিনেটরগণ। অন্যদিকে রিপাবলিকান সিটে ৮ জনের ভেতর অবসরে যাচ্ছেন তিনজন। এছাড়া আসন্ন নির্বাচনে মিজৌরি ও মিনিসোটা এই দুই স্টেটের দুজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেটর ও অপর শূন্য দুটি আসন ককাসের মাধ্যমে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মিডটার্ম ইলেকশন নিয়ে শুরুতে বলছিলাম বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের বিভক্তি নিয়ে। সেটা যে কতটা প্রকট বোঝা গেল কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের মাইনরিটি লিডার ডেমোক্র্যাট ন্যান্সি পেলোসি যখন বললেন বিতর্কিত এই রিপাবলিকান প্রার্থী বর্তমানে নিয়োগ পেলেও আমরা যদি মিডটার্ম ইলেকশনে উভয়কক্ষে জিতে যাই তবে তাকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন করা হবে। এর বিপরীতে রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডজি গ্রাহাম স্পষ্ট বললেন বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা রাজনীতিতে জড়িয়েছে। তারা ড. ব্লাজিওর গোপনীয় চিঠি সিনেট কমিটিকে না দিয়ে ফাঁস করেছে মিডিয়ায়। এই ঘটনাটিরও একটি পূর্ণ তদন্ত করে বিচার করা হবে। অভিজ্ঞজনরা এই নিয়ে বলছেন ডেমোক্র্যাটরা আসলেও বিষয়টিকে কোনভাবে ছেড়ে দেবে না। কারণ প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় রিপাবলিকান বিরোধিতার কারণে তারা তাদের পছন্দের জাজকে নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়নি। ফলে ব্রেট মাইকেল ক্যাভানোর সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার বিষয়টি আপাতত কিংবা চিরতরেই আটকে গেল কিনা ভবিষ্যতই তা বলতে পারে। বর্তমান সময়ে এফবিআই তদন্ত তাকে যদি নির্দোষ প্রমাণিত করে এবং অতঃপর হয়ত রিপাবলিকানদের ভোটে ক্যাভিনো সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োজিত হবেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার রাশিতে যে রাহুর বিপাক শুরু হয়েছে সে দশা কাটবে কি? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ক্যাভিনোর ব্যাপারে সফলও হন তথাপি প্রশ্ন থেকে যায় তার দল কি মিডটার্ম ইলেকশনে বিজয়ী হতে পারবে? আর না হলে তিনি জানেন তার ভবিষ্যত কি হতে যাচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন কংগ্রেস রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং ডেমোক্র্যাটরা সেখানে সংখ্যা লঘু। মার্কিন সিনেটে ৫১ জন রিপাবলিকান এবং ৪৯ জন ডেমোক্র্যাট রয়েছে। কাজেই ডেমোক্র্যাটরা এই নির্বাচনে মরিয়া হয়ে উঠেছে কংগ্রেস দখলের জন্য। প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিচারপতি নাটকটি ভোটারদের প্রভাবিত করার সবচেয়ে বড় অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও নানা সমীক্ষায় বলা হচ্ছে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনী নৌকার পালে জয়ের বাতাস লেগেছে। তবে সিনেট ভোটে যেসব পদে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার মধ্যে ১০টি স্টেটে ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছিলেন হিলারির বিরুদ্ধে। পেছনের ঘটনাবলীর দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে ১৯৩৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেছেন তাদের প্রথম মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ২০ শতাংশ প্রার্থীকে পর্যন্ত পরাজিত হতে দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের জন্য এটা তাই আশংকিত হবার সময়। ডেমোক্র্যাটরা জিতে গেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হতে হবে সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট নিজেও অবগত। এই মিডটার্মকে তাই বলা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণকারী নির্বাচন। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×