ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির আশা- শেষ মুহূর্তে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৪ অক্টোবর ২০১৮

বিএনপির আশা- শেষ মুহূর্তে সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে

শরীফুল ইসলাম ॥ সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে করতে শেষ মুহূর্তে হলেও বর্তমান সরকার উদ্যোগ নেবে বলে আশাবাদী বিএনপি। আর এ আশায়ই মুখে হাঁকডাঁক দিলেও বাস্তবে রাজপথের কঠোর কর্মসূচীর দিকে যাচ্ছে না দলটি। এমনকি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের পরামর্শে কৌশলে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতকে আপাতত দূরে রেখে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে রাজনৈতিক কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। সূত্র মতে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ইতিমধ্যে ৭ দফা দাবি পেশ করে তা আদায় না হলে কোন অবস্থাতেই নির্বাচনে যাবে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের বিষয়ে ভিন্ন প্রস্তুতি চলছে। সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনেই যে নির্বাচন হবে সেটি দলের নেতাকর্মীদের চিন্তায় রয়েছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার যদি ন্যূনতম পদক্ষেপ নিয়েও দলের নেতাকর্মীদের আস্থায় আনতে পারে তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আর তা না হলে নির্বাচনের বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকেই তাদের যেতে হবে। জানা যায়, বিএনপির থিকে ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা এবং দেশ-বিদেশে তাদের যারা শুভাকাক্সক্ষী রয়েছে তারা সবাই চায় বিএনপি যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জনের মতো এবার কিছু না করে। যে করেই হোক মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হলে যেন বিএনপি নির্বাচনে যায়। কারণ, এবার নির্বাচন বর্জন করলে দলটি রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি বেকায়দায় পড়বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে বিএনপি যে ৭ দফা দাবি পেশ করেছে তা যে পুরোপুরি আদায় হবে না তা দলের সিনিয়র নেতারাও জানেন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারকে চাপে রাখতে এবং তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে এ কর্মসূচী দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখাও দিতে চায় বিএনপি। এ জন্য একটি খসড়াও প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। সূত্র জানায়, বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি যেমন বিভিন্নভাবে বেকায়দায় রয়েছে তেমনি সরকারও নানামুখী চাপে রয়েছে। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে করে পুরো ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে। তাই আওয়ামী লীগও এবার চাইবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো যেন একতরফা কোন নির্বাচন না হয়। এমনটি ধরে নিয়েই বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি আশার সঞ্চার হয়েছে যে শেষ মুহূর্তে হলেও সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের একটি উদ্যোগ নেবে। এদিকে অতীত কর্মকা-ের জন্য সমালোচনাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের চাপে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আপাতত দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে বিএনপি আর এ কারণে এবারই প্রথম জামায়াতকে ছাড়া রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে দলটি। জামায়াতের নেতাকর্মীরা যোগ না দেয়ায় এবার বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম কম হলেও দলের নেতাকর্মীরা মনে করছেন নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীরা মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন এবং তখন বিভিন্ন কর্মসূচীতে লোকসমাগমও বেশি হবে। উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ৩০ অক্টোবর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ থেকে বিএনপি যে ৭ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেছে তা বাস্তবায়নে ধীরে ধীরে আন্দোলন চাঙ্গা করতে চায় দলটি। দলটির ৭ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদ বাতিল, তফসিলের আগেই খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার বিরুদ্ধে দায়ের সব মামলা প্রত্যাহার এবং সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, সাজা বাতিল ও মামলা প্রত্যাহার, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোন মামলা না দেয়া, পুরনো মামলায় কাউকে গ্রেফতার না করা, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী-সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ ও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য লোকদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে কোন ধরনের বিধি-নিষেধ ছাড়াই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সশস্ত্রবাহিনী নিয়োগ এবং নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ৭ দফা দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন কৌশলে সরকারের সঙ্গে সমঝোতারও চেষ্টা করবে বিএনপি। এ জন্য দলের ক’জন নেতা ও দলের পক্ষে কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার এমন কিছু লোকও নানামুখী কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট ‘জাতীয় ঐক্য’ করার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করেও দলের জন্য সুবিধা আদায় করতে পারেনি বিএনপি। একদিকে ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ না দিলে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে নেয়া হবে না বলে ড. বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ৫ বার ক্ষমতায় যাওয়া দল জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হয়ে দলের জন্য কি লাভ নিয়ে আসতে পারবেÑ এ নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। এমন বাস্তবতার আলোকে বিএনপি আশা করে সরকার যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে কিছুটা ছাড় দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয় সেক্ষেত্রে তাদের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়র পথ সুগম হবে। আর সরকার যাতে এমন একটি উদ্যোগ নেয় সেজন্যই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে বিএনপি। জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন সিনিয়র নেতা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া প্রতিমাসে অন্তত একবার বিদেশী কূটনীতিকদের একসঙ্গে জড়ো করে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। এ ছাড়া দলের ক’জন নেতা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য সহযোগিতা চান। এমনকি বিএনপি মহাসচিব জাতিসংঘ ও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। এর মাধ্যমে সরকারকে শেষ পর্যন্ত বিএনপির বিষয়ে কঠোর অবস্থানের বদলে কিছুটা হলেও নমনীয় করা যাবে বলে দলটির নেতাকর্মীদের বিশ্বাস। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, শীঘ্রই দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে যাকে সরকার বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। ব্যারিস্টার মওদুদের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এটি আসলে রাজনৈতিক বক্তব্য। তবে আন্দোলন করে যে তেমন বেশি সুবিধা করা যাবে না তা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভাবনায় রয়েছে। তবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুধু আন্দোলনের কথা চিন্তা করেই বলেননি। তিনি বাস্তবতার কথা চিন্তা করে বলেছেন। কারণ, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একতরফা নির্বাচন আর সম্ভব নয়। কারণ, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে চোখ রেখেছেন। তাই শেষ পর্যন্ত সরকার কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেবে এমন প্রত্যাশা বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে। আর এ প্রত্যাশা পূরণে বিভিন্নভাবে চেষ্টাও করা হচ্ছে।
×