ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দু’একদিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন ;###;সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ;###;কোটা আন্দোলনকারীরা আজ সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া জানাবে

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা থাকছে না ॥ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৪ অক্টোবর ২০১৮

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা থাকছে না ॥ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে সব কোটা তুলে দিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে সচিব কমিটির সুপারিশ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সচিব কমিটির সব সুপারিশই অনুমোদন দেয়া হয়। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে কোটা থাকছে না। এক্ষেত্রে নিয়োগ হবে কেবল মেধার ভিত্তিতে। দুই-একদিনের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ওরা চাইছিল কোটা বাতিল হোক, বাতিল করে দিলাম। এ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন নেই। তবে যদি কখনও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোটার দাবি সামনে আসে, তখন সেটা রাষ্ট্র বিবেচনা করবে।’ এদিকে সরকারের এ পদক্ষেপে কোটা সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সঙ্কটের ইতিবাচক সমাধান হতে চলেছে। সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া জানাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। কোটা সংস্কার নিয়ে গত কয়েক মাস দেশে আন্দোলনের নামে পানি কম ঘোলা করা হয়নি। কোটা সংস্কারে সরকার প্রথম থেকেই ইতিবাচক অবস্থান দেখালেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এক পর্যায়ে নেমে পড়ে সরকার বিরোধীরা। দেশজুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়ে পড়ে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তাদের লক্ষ্য ছিল কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে পুঁজি করে বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা। কোটার যৌক্তিক সংস্কারে শুরু থেকেই সরকার ইতিবাচক অবস্থানে থাকলেও বিশেষ একটি গোষ্ঠী ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ এপ্রিল সংসদে বলেন, সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। তবে পরে সংসদে তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখতে হাইকোর্টের রায় আছে। এরপর সরকারী চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে গত ২ জুন একটি কমিটি করে সরকার। কোটা পর্যালোচনা কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেনÑ লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ, অর্থ বিভাগের সচিব মুসলিম চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের সচিব আকতারী মমতাজ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান। গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কোটা বাতিল করে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল সচিব কমিটি। বুধবার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের যে সুপারিশ করেছিল সরকারী কমিটি, তাতে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। অর্থাৎ নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত চাকরিতে কোন কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম। প্রথম শ্রেণীর চাকরি শুরু হয় নবম গ্রেড দিয়ে। এর ওপরের পদগুলো সাধারণত পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ হয়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরি ১০ম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেডের মধ্যে। ব্যতিক্রম ছাড়া শুরুর পদেই নিয়োগ হয় এবং সেখানেই কোটা নির্ধারণ হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারী চাকরিতে বর্তমানে ৫৫ শতাংশ নিয়োগ হয় অগ্রাধিকার কোটায়। বাকি ৪৫ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধা কোটায়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতেও আছে বিভিন্ন ধরনের কোটা। জানা গেছে, সরকারী কমিটি কোটা নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে গত ১০টি বিসিএসের তথ্য তুলে ধরা হয়। তথ্য বিশ্লেষণে কমিটি দেখতে পায়, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, নারী কোটায় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ১ দশমিক ১৭ শতাংশ প্রার্থীকে চাকরি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। আর বিদ্যমান ৩০ শতাংশ কোটা সংস্কার বা বাতিল করার ক্ষেত্রে আইনগত কোন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি না, সে বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে মতামত চাওয়া হলে তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানো বা বাড়ানো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের এখতিয়ার। এ সংক্রান্ত মামলার লিভ টু আপীলের রায় কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। কমিটির প্রতিবেদনে সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরা হয়। বলা হয়, বিদ্যমান কোটা অনুযায়ী পদ পূরণের বিষয়টি যে জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, সেটিও উঠে আসে প্রতিবেদনে। আবার শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নির্বাহী আদেশে সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ পদে নিয়োগ করা হয় অগ্রাধিকার কোটায়। অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা (পরে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এখন নাতিনাতনি) কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা এবং ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা। সর্বশেষ ২০১২ সালে বিদ্যমান অগ্রাধিকার কোটায় কাক্সিক্ষত যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সেই কোটা থেকে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু হয়। এর বাইরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতে পোষ্য, আনসার-ভিডিপিসহ আরও কিছু কোটা রয়েছে। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, কমিটির রিপোর্ট মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়। তিনটি সুপারিশ ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ, কোটা বাতিল এবং কোটা বাতিলের ফলে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর বিষয়ে যথাপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মন্ত্রিসভা সচিব কমিটির তিনটি সুপারিশই অনুমোদন দিয়েছে জানিয়ে শফিউল বলেন, যদি কখনও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তবে সরকার তা করতে পারবে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে কোটা বহাল আছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আজ-কালের মধ্যে আমরা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করবে। আশা করছি দুই-তিন দিনের মধ্যে (প্রজ্ঞাপন) হয়ে যাবে। আজ প্রতিক্রিয়া জানাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ॥ বুধবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) একটি কক্ষে বৈঠকে বসেন কমিটির ২৫ নেতা। কমিটির আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, বুধবার মন্ত্রিসভা কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। এনিয়ে আমরা জরুরী বৈঠকে বসেছি।’ বৈঠক শেষে পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ কোটা বাতিলের বিষয়ে অস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র চাইলে যে কোন সময় বাতিলের বিষয়টি পরিবর্তন করতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্যটি কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তের বিষয়ে অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আমরা কোটার সম্পূর্ণ বাতিল চাইনি। আমাদের পাঁচ দফার আলোকে সংস্কার চেয়েছি। একই সঙ্গে আমাদের তিন দফা দাবি মেনে নিতে হবে। তিন দফা দাবি হলো, সব আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে, হামলাকারীদের বিচার করতে হবে ও পাঁচ দফার আলোকে কোটা সংস্কার করতে হবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলেনের মাধ্যমে আমাদের অবস্থান জানাবো। কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘কোটা সংস্কারের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বাইরের সব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আমাদের এই আন্দোলনের নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের কাছ থেকে আমরা পরামর্শ নেব। তাদের সবার সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করব। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনেই আমাদের অবস্থান জানানো হবে।’
×